সাফল্যসমগ্র বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ডেল কার্নেগির সাফল্য বিষয়ক তিনটি বইয়ের সংকলন “সাফল্যসমগ্র।” এখানে ডেল কার্নেগি মানব জীবনে সফলতার মূলমন্ত্র সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ব্যক্তি-জীবনে সফলতার জন্য যা যা গুণাবলি ও দক্ষতার প্রয়োজন, সে সম্বন্ধে চমকপ্রদ পরামর্শ ও বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরেছেন এই মহান লেখক। ব্যক্তি-জীবনে কাজের গুরুত্বকে তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। কাজের জন্য আমাদের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, উচ্চাকাক্সক্ষা ও সময়ের যেমন গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন কঠোর শ্রমের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, ব্যক্তির মধ্যে এমন কিছু থাকে যা অনায়াসেই হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে তাদের বশে আনা সম্ভবপর। ব্যক্তিত্বহীন মানুষ কদাচিৎ সফল হতে পারে। পৃথিবীর যে কোনো দেশের ইতিহাস ঘাঁটলেই এ কথার সত্যতা আপনাদের চোখে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। একবার ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডিসরেলী আর গ্ল্যাডস্টোনের কথাটা ভাবুন। ব্যক্তিত্বের জোরেই তাঁরা ইতিহাসে খ্যাতিমান বলে পরিচিত হয়েছিলেন। সাফল্য তাঁদের অনুসরণ করেছিল সারা জীবন। নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অসম্ভব সচেতন ছিলেন জার্মানির প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক। তাঁর এই ব্যক্তিত্বই তাঁর অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা আর সাফল্যের মূল কথা তাতে কোনো রকম সন্দেহ নেই কারও। ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে কেমন করে? এ কথার উত্তর দিতে গিয়ে ডেল কার্নেগি বলেন, “মানুষ আর পশুর মধ্যে তফাৎ হলো মানুষ ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে সহজেই ক্ষমতা দখল করতে পারে অথচ পশুর একমাত্র সম্বল তার দৈহিক শক্তি।” ব্যক্তিত্বের মধ্যে কখনও আহঙ্কারকে জড়িয়ে ফেলা সমীচীন হবে না। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও অহঙ্কার তাদের বেশি এগুতে দেয় নি, এনেছে পতন। কলম্বাসের কথাই এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। মানুষের কতকগুলি ত্রুটির কথা স্বীকার করে নেওয়াই বোধ হয় ভালো। যে কোনো দুঃখজনক পরিস্থিতি বা জটিলতার আবর্তে পতিত হলে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই ভুল পথ গ্রহণ করে। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব বা সাফল্য অনেককেই সঠিক পথ গ্রহণে সাহায্য করতে পারে। এজন্য অবশ্যই প্রয়োজন নিঃসন্দেহে বাস্তববুদ্ধি আর সঠিক পথ গ্রহণে সক্ষমতা। এর মধ্যেই মানব চরিত্রের ব্যাখ্যা মিলতে পারে। পশুর সঙ্গে মানুষের তফাৎ এখানেও। ডেল কার্নেগি মনে করেন, সঠিক জায়গায় পৌঁছানো হলো ক্ষমতারই প্রকাশের ফল : তা হলো, এগিয়ে নেওয়ার শক্তি, ব্যক্তিত্বের শক্তি। আপনি সারা জীবন ধরে যদি মনেপ্রাণে ভালো করতে চান, তাহলে এই শক্তিই আপনি অর্জন করতে চাইবেনÑএই ‘সার্বভৌম’ ক্ষমতা আপনি আরও বেশি করেই চাইবেন। এ শক্তি রয়েছে আপনারই মধ্যে। এটাই আপনাকে সঠিক কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এটাই আপনাকে ভালোভাবে কাজ সম্পন্ন করায়। মানুষ আপনার ক্ষমতার স্পর্শ টের পায়। আপনি সকলকে খুশি করে তুললে তাদের মধ্যে জেগে ওঠে প্রতিক্রিয়া। ক্ষমতার অধিকারী একজন মানুষ সত্যিই অসাধারণ। এ ধরনের মানুষের কাহিনী আপনি পড়ে থাকবেন, তারা কিভাবে তাদের ছাপ রেখে যান মানুষেরই চিন্তা আর কাজে কর্মে। হয়তো এ ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আপনি কখনও এসেছেন। এই শক্তির প্রকাশ আপনিও কখন টের পেয়েও থাকবেন। এটা আপনার উপর উজ্জ্বল কোনো ছাপও রেখে যেতে পারে আর আপনাকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে। যে শক্তি তার উপস্থিতি টের পাইয়ে দেয় সে শক্তি নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই শক্তির জন্যই আপনি আর আমি কাজ করে চলি। সেই শক্তি নয়, যে শক্তি বৃষ্টিধারায় মরুর বুকে ঝরার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য বালুকণা তাকে শুষে নেয়। আমরা সেই শক্তিকেই খুঁজে ফিরি (বলতে গেলে) যা বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, যা ইঞ্জিনকে গতিময় করে চালায় টারবাইন আর ডায়নামো। যে শক্তি সমুদ্র শাসন করে, শাসন করে বিস্তৃত ভূমি আর বাতাসকে। অর্থাৎ সেই কার্যকরী শক্তি। আত্মনিয়ন্ত্রণই এই শক্তির জোগান দিতে পারে। তবে এর অর্থ হলো প্রথমে যে আপনার নিজের উপর বিশ্বাস আছে। আপনার পক্ষে কোনো কাজে সফল হওয়া সম্ভব হবে না যদি না আপনি নিজে জানেন আপনি নিশ্চিত। আপনার মধ্যে যদি ইতস্ততভাব থাকে, বা আরও খারাপ হলে আপনি যদি হতোদ্দ্যম হন তাহলে আপনি কখনই শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে উঠতে পারবেন না। আপনি নিজেকে বলতে চেষ্টা করুন (মাঝে মাঝে কাজটা কঠিন মনে হলেও) যে আপনি সক্ষম, আপনার মধ্যে বেশ কিছু ভালো জিনিস আছে। তারপরেই মনস্থির করে নিন আপনি এগিয়ে যাবেন, উঠবেন আরও... আরও উঁচুতে। নিজেকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করুন। সত্যিকার গ্রহণীয় বস্তু কখনও হঠাৎ এসে পড়ে না। আত্ম-জিজ্ঞেস আর আত্মজ্ঞান অতি দরকারি জিনিস। এটা না থাকলে, বা এর সাহায্য ছাড়া আমাদের নিজেদের কাছ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিসটি আদায় করতে পারবো না। প্রায়ই এটা লক্ষ্য করা যায় আমরা যা পাই তার ঢের বেশি পেতে পারতাম শুধু নিজেদের সম্পর্কে যদি আরও কিছু জানা থাকতো। আপনি নিজেকে ভালো করে দেখুন। যতোটা সম্ভব জানতে চেষ্টা করুন নিজে কিভাবে চিন্তা করেন, কিভাবে আর কেন আপনি কাজগুলো করেন। আপনার নিজের ভালো দিকগুলো আর যা ভালো নয় সেগুলোও ভালো করে জানতে চেষ্টা করুন; নিজের কাছ থেকে যতোটা সম্ভব আদায় করে নিন। নিজেকে আরও যোগ্য করে তুলুন। শক্তির অপব্যয় করবেন না। এ নিয়মটি চমৎকার ভুলবেন না। এরকম করার ফলেই আপনার অন্তর্দৃষ্টি জন্মাবে। আপনি বুঝতে পারবেন কিভাবে আপনার যন্ত্র কাজ করছে। আপনি বুঝতে সক্ষম হবেন। আপনি তার পরিমাপ করতে পারবেন, সেটা তাৎক্ষণিক কি করে চলেছে, কি করতে সে সক্ষম ব্যবহার করলে। এভাবে ডেল কার্নেগি প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্বের শক্তিকে জাগিয়ে তুলে সাফল্যের পথে এগিয়ে চলার অসীম প্রেরণা দান করেছেন। তাঁর রচিত সাফল্য বিষয়ক তিনটি বইয়ের সমাহার “সাফল্যসমগ্র” আপনাকে জাদুকরি সাফল্য এনে দিতে সহায়তা করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।