"হুমায়ূন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ"বইটির মূখবন্ধ: হুমায়ূন আহমেদ এক নক্ষত্রের নাম। তার অকালমৃত্যু সমকালীন বাংলা সাহিত্যকে অনেকটা নিঃস্ব ও স্তম্ভিত করে দিয়ে গেছে। তার বিকল্প পাওয়ার জন্য আমাদের কত দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে, জানি না। শুধুই সাহিত্যই নয়, চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, সঙ্গীত, ম্যাজিক, চারুশিল্প, বৃক্ষ জগৎ- কত ক্ষেত্রেই যে তাঁর অনায়াস বিচরণ ছিল, কৃতি ছিল, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এক জনমে হুমায়ূন আহমেদ যা করে গেছেন, তা অতুলনীয়। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। অকপট সারল্যে ও নান্দনিক মাধুর্যে তিনি বিবৃত করে গেছেন তাঁর নিজস্ব জীবনদৃষ্টি, জীবনদর্শনের বিস্তারিত। সে সব খুঁটিয়ে পড়লে ব্যক্তি মানুষটিকে যেমন জানা যাবে, তেমনি তাঁর রচনাসম্ভারের মর্মার্থ উদ্ধারও সহজতর এবং আরাে আনন্দময়, উপভােগ্য হবে। তার প্রয়াণের এক বছর সময়ও পার হয়নি এখনাে পর্যন্ত। শশাকের বিহ্বলতা, দুঃখ বেদনার আকস্মিক ঝাপটার যে আঘাত, সুহৃদ, ভক্তকুল সেটা এখনাে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। সেই ক্ষত, বিয়ােগ-ব্যথার তীব্র তীক্ষ্ম অনুভূতি থিতিয়ে আসতে আরাে একটু সময় প্রয়ােজন। তারপর শুরু হবে। হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি সম্পর্কিত নির্মোহ বিশ্লেষণ, পর্যালােচনা, মূল্যায়নের ধারা। সময়ই নির্ধারণ করে দেবে বাংলা সাহিত্যের কোনখানে, কোন মর্যাদায় ও উচ্চতায় তাঁর অবস্থান। নির্ণীত হবে কতটা মূল্যবান তাঁর অবদান। হুমায়ুন আহমেদ এক বিস্ময়েরও নাম। সহজ কথাটি খুব সহজ করে তিনি বলতে পারতেন। সেটা এতই সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত যে, কোনাে কৃত্রিমতা আড়ষ্টতা তাঁর ওই আন্তরিক পরিবেশনাকে কখনাে স্নান করতে পারেনি। মানব মনের সূক্ষ্ম জটিল মনস্তত্ত্ব তিনি সন্ধানী চোখে আবিষ্কার করেছেন বারংবার, অননুকরণীয় গদ্যশৈলীতে মনােগ্রাহী শিল্পরূপ দিয়েছেন তার । সেই যে অদ্ভুত সুন্দর মুন্সিয়ানা, গল্প বলার জাদুকরী স্টাইল, কৌতুক ব্যঙ্গ-রসের মিশেলে আকর্ষক উপস্থাপনা, নিঃসন্দেহে তা অনুপম; অনন্যসাধারণ এবং ব্যতিক্রমী। নিরাভরণ নির্মেদ গদ্য লিখেছেন তিনি- যা সহজেই মনে দাগ কাটে। ভাবায়। আলােড়িত শিহরিত আনন্দিত করে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রসমূহের বৈশিষ্ট্য বহুবিধ রহস্যময় বৈচিত্র্যে ভরপুর, কল্পনায় বিচিত্রগামী, বুদ্ধিবৃদ্ধিক উল্কর্ষে প্রশংসনীয়, এমনকি উল্টাপাল্টা পাগলামিতেও পরিপূর্ণ। সব কিছুর মধ্যে রয়েছে সারল্যের প্রাবল্য- সেটা কখনােই আরােপিত হয়ে চেপে বসে না।আপনা-আপনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় অবলীলায়। রঙ্গ-ব্যঙ্গ, হাসি ঠাট্টা তামাশা কৌতুক হুমায়ূন আহমেদের রচনাকে লাবণ্য-স্নিগ্ধতা দিয়েছে, সবার কাছে খুব সহজে গ্রহণযােগ্য, আদরণীয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এবারের একুশের বইমেলা ২০১৩ উৎসর্গ করা হয়েছে হুমায়ুন আহমেদকে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা এই প্রথমবারই কারাে নামে উৎসর্গিত হলাে। হুমায়ূনবিহীন বইমেলায় তিনি কতটা আছেন? অনেকখানিই আছেন। বলা চলে, এবারের বইমেলা হুমায়ূনময় হয়েই আছে। তাঁর নতুন কোনাে লেখা আমরা আর পাবাে না, এটা অমােঘ সত্য। কিন্তু তাঁর বিপুল যে রচনাসম্ভার, বহুমাত্রিক নিরিখে তাঁর ওপর আলাে ফেলবেন হুমায়ূনভক্ত ও অনুরাগীরা। অনেকেই তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন, কাছে থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ অবলােকনের সুযােগ ঘটেছে তাদের। সৌভাগ্যক্রমে তাদের বেশিরভাগ মানুষই স্মৃতির আয়নায় হুমায়ূনকে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। লেখালেখি করেছেন তার ওপর। সঙ্গত কারণেই সেগুলাে মূল্যায়নধর্মী কোনাে লেখা নয়। হওয়ার কথাও নয় অবশ্য। সেই সময় এখনাে আসেনি। একথা বলেছি আগেই। এ ধরনের লেখা আরাে প্রকাশিত হবে। প্রকাশিত লেখাসমূহ থেকে বাছাইকৃত কিছু স্মৃতিচারণ এই গ্রন্থে মলাটবন্দি করা হলাে। এসব লেখা হুমায়ূনমনস্ক পাঠকদের কিছুটা হলেও তৃপ্তি দেবে, বিস্ময়ের বরপুত্র এই অসামান্য লেখককে জানতে বুঝতে সহায়ক হবে। হুমায়ুন আহমেদ কেমন সময়ে বেঁচেছিলেন, তাঁর সমকাল, লেখালেখি, সেই সময়ের আর্থ-সামাজিকরাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেহারা চালচিত্র কেমন ছিল, সেই ছবি মূর্ত হয়েছে এসব লেখায়। তাৎক্ষণিকতার আবেদন ছাপিয়ে উঠে কোনাে কোনাে লেখা শৈল্পিক উৎকর্ষে মণ্ডিত হয়েছে- সেগুলাের মূল্য অপরিসীম। শেষত আরেকটি প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যেতে চাই। হুমায়ূন আহমেদ নিছক একজন কথাশিল্পীই ছিলেন না। তাঁর সত্তা বহুধা বিভক্ত, তাঁর প্রতিভা মেধা, সাফল্য সিদ্ধির দ্যুতি নানা ক্ষেত্রে বিচ্ছুরিত, উদ্ভাসিত। ছিলেন নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, সঙ্গীত রসিক, গীতিকবি, বৃক্ষপ্রেমিক, ম্যাজিশিয়ান, চারুশিল্পী। আড্ডাবাজ, ভ্ৰামণিক, স্বাপ্নিক, অধ্যাপক। একের মধ্যে ছিলেন অনেক। অতি বিরলপ্রজদের একজন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যের সবগুলাে দিক একটি মাত্র স্বল্পায়তন গ্রন্থে, অল্প কিছু লেখায় তুলে ধরা কোননাক্রমেই সম্ভব নয়। তারপরেও চেষ্টা করা গেল, বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মত। অতএব, এ গ্রন্থ পাঠ পরবর্তী অনুভব-উপলব্ধি এমনও হতে পারে যে, তৃপ্তির চেয়ে অতৃপ্তিই বুঝি থেকে গেল বেশি। তা হােক না, বিশেষ কোনাে ক্ষতিবৃদ্ধিও নেই এতে।
হাসান হাফিজের জন্ম নারায়ণগঞ্জের সােনারগাঁও উপজেলার এলাহি নগর গ্রামে, ১৫ অক্টোবর ১৯৫৫। যখন ছিলেন স্কুলছাত্র, প্রথম ছড়া ছাপা হয় ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে। পড়াশােনা করেছেন হােসেনপুর হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য,গণযােগাযােগ ও সাংবাদিকতায় এম.এ.(ডাবল)। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত। দৈনিক বাংলায় সূচনা। আরাে কাজ করেছেন জনকণ্ঠ, কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ (এখন পাক্ষিক), বৈশাখী টেলিভিশন এবং আমার দেশ-এ। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ ১৪০। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এই লেখক পেয়েছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ডাকসু সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাঙ্ক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, কলকাতার সৌহাদ্য কবিতা উৎসব সম্মাননা, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক সম্মাননা, ঢাকা রিপাের্টার্স ইউনিটি লেখক সম্মাননা, কবিতালাপ পুরস্কার, কবি জসীম উদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার, এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, স্বপ্নকুঁড়ি পদক ইত্যাদি। হাসান হাফিজ বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (এফইজেবি) সাধারণ সম্পাদক, বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য। সাহিত্য-সাংবাদিকতা সূত্রে ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের ১৫ দেশ। তার স্ত্রী শাহীন আখতার ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ডা. শিহান তাওসিফ গৌরব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত।