আমি গভীর বিস্ময়ে বহুকাল যাবৎ লক্ষ করে আসছি, আমাদের দেশে সুপরিচিত পশ্চিমী সাহিত্যবেত্তাদের প্রায় কেউই মাক্সিম গোর্কির ‘মা’ সম্পর্কে তেমন প্রশংসনীয় মন্তব্য করেন নি। যারা অনুকম্পায়ী পর্যালোচনা করেছেন তারা সকলেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী; না বললেও চলে, তারা মার্ক্সবাদী। তাদের সংখ্যা অল্প এবং আমাদের হাটে তারা তেমন কল্কে পান না। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহিত্যসমালোচক, যাদের রচনার সঙ্গে নানাবিধ সারস্বত ও বিদ্যায়তনিক কারণে আমাদের ঘনিষ্ঠতা এবং আমাদের শিল্পসম্পৃক্ত চিন্তাভাবনা ও রুচি তৈরি হয়, গোর্কির প্রতি তাদের অসংবেদনা বর্তমান। এর ফলে আমাদেরও অনাগ্রহী ও বীতরাগ হওয়া স্বাভাবিক ছিল, অথচ বাঙালি পাঠক তা হয় নি। উভয় ঘটনাই আপাতদৃষ্টে কিঞ্চিৎ প্রহেলিকাময়। এর একটা অর্থ হল গোর্কি-নাপসন্দ পশ্চিমী রসগ্রহীতাদের অন্যান্য বিচার-বিবেচনাকে আমরা যেমনই প্রশ্রয় দিই, গোর্কির ব্যাপারে তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করার মতো নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত ও বিবেচনা আমাদের ভিতরে প্রায় অজ্ঞাতেই তৈরি হয়ে থেকেছে। যেমন বলি : ভাদিমির নবোকভকে আমি খুবই উল্লেখযোগ্য লেখক ও বড়োমাপের পণ্ডিত মনে করি, এবং তাকে পছন্দও করি। আমার নিকট সাহিত্যসমালোচক নবোকভের গুরুত্ব সবিশেষ। সকলেই জানেন, তিনি বহুভাষী। ‘লেখক হিসেবে গোর্কি সর্বদাই তাঁর সমকালীন ঘটনাবলির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন এবং নিজের রচনার মধ্যে এমন ভেদরেখা টেনে দেন নি যাতে কতটুকু একজন সাহিত্যিকের লেখা আর কতটুকু এক বিপ্লবী সাংবাদিক ও প্রচারকর্মীর তা ধরা যায়। সত্য এর বিপরীতটাই। তার মহত্তম সাহিত্যকীর্তি সর্বদা সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করে উথিত হয়েছে : এক মফস্বলী সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা থাকাকালে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রারম্ভিক সগ্রামের ফসল ফমা গর্দেইয়েভ প্রথম বিপ্লবের সমকালে সাংবাদিকের কার্যাবলি থেকে উঠে আসা মা; আর বিজয়ী প্রলেতারীয় বিপ্লব ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে উদ্ভূত ক্লিম সামগি। —গেয়র্গ্ লুকাচ্ (‘মুক্তিদাতা’, য়োরোপীয় বাস্তববাদ বিবেচনা)
(মার্চ ২৮, ১৮৬৮ – জুন ১৮, ১৯৩৬) বিখ্যাত রুশ সাহিত্যক। তিনি নিজেই তার সাহিত্যক ছদ্মনাম হেসেবে বেছে নেন 'গোর্কি' অর্থাৎ 'তেতো' নামকে। তার অনেক বিখ্যাত রচনার মধ্যে মা একটি কালজয়ী উপন্যাস। প্রথম জীবন মাক্সিম গোর্কি নিঞ্জি নভগরদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯ বছর বয়সে পিতৃমাতৃহীন হন। ১৮৮০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তার দাদীমাকে খুঁজতে গৃহ ত্যাগ করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এবং দীর্ঘ ৫ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমন করেন। তিনি ১৮ জুন ১৯৩৬ (৬৮ বছর) সালে মৃত্যু বরণ করেন।