ভাইজান এভাবে আমার সর্বনাশ করলেন ? আমি হতবিহব্বল হয়ে প্রশ্নকর্তা অচেনা লোকটির দিকে তাকিয়ে আছি । অফিস থেকে ফিরে কি এক কাজে টরেন্ট শহরের বাংলা পাড়া বলে খ্যাত ড্যানফোর্থের দিকে এসেছিলাম। ঢাকা কাবাবের পাশ দিয়ে যেতেই কলিজা সিঙাড়া'র তীব্র আকর্ষণে আকর্ষিত হয়ে সিঙাড়ায় কামড় বসাতেই এই প্রশ্নকর্তার পাল্লায় পড়লাম। আমার মুখে তপ্ত কলিজার ভগ্নাংশ মিশ্রিত সিঙাড়া'র অংশটিকে জিভ দিয়ে ঠেলে এক পাশে রেখে বিনয়ের সাথে বললাম : 'ভাই, আপনার সাথে কখনো দেখা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না, আপনাকে তো আমি চিনিই না, সর্বনাশ করলাম কীভাবে বুঝতে পারছি না। তিনি আমার কথায় বিচলিত না হয়ে কিছুটা রাগত স্বরে বললেন, ' ভাইজান, আপনারা লেখালেখি করেন, বই-উপন্যাস লেখেন, কিন্তু এসব লেখা আমাদের জীবনকে কীভাবে ওলোটপালোট করে দেয় সেসব খবর রাখেন? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভেজাল লাগিয়ে খুব আনন্দ পান ? এবার আমার হতচকিত হওয়ার পালা। মুহূর্তেই বুঝে ফেললাম তিনি আমার নতুন উপন্যাস 'হাউজ হাজব্যান্ড' নিয়ে কথা বলছেন। রাগী মানুষের রাগ কমানোর ব্যাপারে de -escalation টেকনিক আমার জানা। আমি ভদ্রলোকের ফিলিংসকে আমলে এনে ওনার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে মুখে ভদ্রতার হাসি ঝুলিয়ে প্রসঙ্গ টিকে একেবারে ইউটার্ন করে বললাম , 'আপনার অনুভূতিটি বুঝতে পারছি ভাই, আগে আসেন চা সিঙাড়া খেয়ে নেই , তারপরে সব কথা শুনবো।' আমার কপাল ভালোই বলতে হবে। মিতা সাথে নেই। মিতা সাথে থাকলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তাম। মিতাকে রেখে এসেছি 'মারহাবা গ্রোসারি স্টোরে'। সেখানে গ্রোসারি শেষ করে জিনিষপত্র ওখানেই ট্রলিতে রেখে শাড়ি হাউজে মিতার ঢুঁ মারার কথা। মহিলারা গ্রোসারি এবং শাড়ি কাপড়ের দোকানে আগ্রহের সাথে ও আনন্দের সাথে সময় অতিবাহিত করেন বলে আমার ধারণা। মিতার সাথে ব্যাঙ্ক কার্ড , ক্রেডিট কার্ড আছে। সুতরাং আমি অন্তত ঘন্টাখানিক নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। মিতাকে এটা-ওটা বলে কেটে পড়েছি। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে মুক্ত স্বাধীনতা উপভোগ করতে যেয়ে এই কলিজা সিঙাড়া'র পাল্লায় পড়ে ফেঁসে গেলাম। সিঙাড়া শেষ করে চায়ে চুমুক দিয়ে তিনি এবার শুরু করলেন : 'ভাইজান আপনাদের কানাডায় আসলাম মাত্র তিন চার মাস, এমনি নিজেরা ইমিগ্রেশন নিয়ে অনেক ক্রাইসিসে আছি, নতুন করে উটকো ঝামেলায় জড়ানোর কোনো মানে হয়, আমার সংসারে আগুন ধরালেন ভাই ?' আপনার কী এক বইয়ের উৎসবে যেয়ে আমার তো বারোটা বাজিয়ে ফেলছেন!' আমি এখনো আগা-মাথা কিছু বুঝছি না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি, তিনি আমার হাউজ হাজব্যান্ড উপন্যাস নিয়ে কিছু একটা কথা বলতে চান। কাউন্সেলিং করতে যেয়ে শ্রোতা হিসেবে empathy , sympathy আমার বিশদ ধারণা আছে। আমি আমার বইয়ের সাবজেক্ট কে পাশকাটিয়ে যতদূর সম্ভব বিনয় ঢেলে বললাম, 'ইমিগ্রেশন নিয়ে কী হয়েছে ভাই ? তিনি বললেন, 'ভাইজান সুখে থাকলে ভুতে খায়। দেশে ছিলাম খেয়ে পরে ভালোই ছিলাম। শ্বশুরবাড়ির কথা শুনে ভিজিটর বিষয় কানাডায় এসে পার্মানেন্টলি এখানে থেকে যাওয়ার জন্যে দালালদের টাকা ঢালতে যেয়ে ফকির হয়ে যাচ্ছি, এসবের মধ্যে আপনার হাউজ ওয়াইফ না হাউজ হাজব্যান্ড বই ...।' আমি ইমিগ্রশন ক্রাইসিস এড়িয়ে হাউজ হাজব্যান্ডের কাছে ফিরে এলাম। কিছুটা হালকা তেজ দেখে বললাম ,'ভাই দয়া করে একটু ঝেড়ে কাসুন তো , আমার বই আপনার কী ক্ষতি করেছে ?'
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা শুরু করেন। University of Guelph থেকে ফ্যামিলি এন্ড কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি (অনার্স প্রোগ্রাম) নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্টো ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে আসছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্প ‘হোমলেস’, ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’, ‘জোৎস্না ম্যানশন’, ‘স্বপ্নের ইমিগ্রেশন’, ‘সিঙ্গেল মাদার’, প্রভৃতি জনপ্রিয় ধারাবাহিক মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পায়। লেখকের বেশ কিছু লেখা পরবাসী ব্লগ' নামে জনপ্রিয় ব্লগে, কানাডার জনপ্রিয় 'সাপ্তাহিক বাংলা মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে । এবছর 'হোমলেস', 'স্বপ্নের ইমিগ্রেশন', 'জোসনা ম্যানশন' উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হচ্ছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। 'মানসিক স্বাস্থ্য (Mental Health ) নিয়ে জানা অজানা কথা' নামে লেখকের একটি প্রবন্ধমূলক লেখা ২০২১ সালে 'টরেন্টো বাংলা স্কুল' এর সম্পাদনায় 'বর্ণ মালা' নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।