"কৃত্তিবাস পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত সংকলন ১" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা কৃত্তিবাস পত্রিকার সূচনার ইতিহাস বিচিত্র। তার জন্মলগ্নে কোনও আয়ােজন বা পরিকল্পনার চিহ্ন ছিল না। দুটি অর্বাচীন কবিযশঃপ্রার্থী যুবক প্রকাশনা জগতের প্রবাদপুরুষ সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্তের (ডি কে গুপ্ত) কাছে এসেছিলেন তাদের লেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে। উদ্দেশ্য, একটি সৌষ্ঠবী কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ব্যবস্থা করা। ডি কে তাদের উচ্চাশা ও স্বপ্ন ভেঙে দেননি। বরং পরামর্শ দিয়েছিলেন, শুধু দু’জনের। কবিতার বই কেন, তার চেয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হােক, যেখানে সমকালের বাংলা। কবিতার ছবি ফুটে উঠবে। এই পরামর্শ সেই দুই অর্বাচীনের মনঃপূত হল। আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে জুটিয়ে তারা একটি পত্রিকা প্রকাশের কাজে নেমে পড়লেন। দিলীপকুমার বাংলার এক আদিকবির নামে পত্রিকার নাম দিলেন— কৃত্তিবাস। সেই শুরু তার পর আর এই পত্রিকাকে অপমৃত্যুর পথে যেতে হয়নি। যদিও বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটির নানা রূপান্তর ঘটেছে—ত্রৈমাসিকের সময়সীমা রক্ষিত হয়নি, কখনও বছরে বেরিয়েছে। একটি মাত্র সংখ্যা, আবার মাসিক পত্রিকার। চেহারায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে একটানা কয়েকবছর। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কৃত্তিবাস পত্রিকা প্রবল ঝড় তুলেছিল। কোনও পূর্ব-প্রচার বা বিজ্ঞাপন ছিল। পত্রিকাটি পাঠকদের চমকিত করেছিল হঠাৎ আলাের ঝলকানির মতাে। লিটল ম্যাগাজিনের স্বর্ণযুগ তখনও অদুরে। অথচ সে সময়েই কৃত্তিবাস যে-ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, তা আজও স্বপ্নের মতন। প্রথম সংখ্যা কৃত্তিবাস-এ কোনও লড়াকু মনােভাব ছিল না। কিন্তু কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পরই যেন হয়ে উঠল উগ্র আধুনিকদের সংগ্রামী মুখপত্র। কৃত্তিবাস-এর প্রথম কয়েকটি সংখ্যার প্রচ্ছদে। অবশ্য লেখা ছিল ‘তরুণতম কবিদের মুখপত্র। জন্মলগ্ন থেকেই স্থির হয়েছিল এখানে শুধু তরুণ কবিদের লেখাই প্রকাশিত হবে। আশ্চর্যের বিষয় সে সময়ের কোনও কোনও প্রতিষ্ঠিত আধুনিক কবি এই পত্রিকার চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে। নিজেরাই পাঠাতেন কবিতা। কিন্তু তাদের কবিতা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সকলের জন্য কৃত্তিবাস-এর দরজা খােলা ছিল। রাজনৈতিক মতভেদ বা অন্য কোনওরকম দলাদলি কবিতা-বিচারের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কৃত্তিবাস-এ। তবে, দলমত নির্বিশেষে সকলের লেখার অধিকার থাকলেও ধীরে ধীরে পত্রিকাটিকে ঘিরে একটি গােষ্ঠীও গড়ে ওঠে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি নতুন কাব্য। আন্দোলন। কৃত্তিবাস কবিগােষ্ঠী তখনকার দিনের সমালােচকদের কলমে কখনও নিন্দিত, কখনও ধিকৃত হয়েছেন। কিন্তু তারা তাদের আলােচনায় কৃত্তিবাসকে কখনও বাদ দিতে পারেননি। কৃত্তিবাসের কবিরা যে নতুন রীতির কবিতা লিখেছিলেন, তা শুধু সৌন্দর্যের নির্মাণ নয়, রূপকল্পের সন্ধান নয়, এইসব কবিতা যেন তাদের রচয়িতাদের জীবনযাপনের শিল্পিত প্রতিচ্ছবি। বাংলাভাষার অনেক প্রধান কবি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এই পত্রিকায়। কৃত্তিবাস একটু উচ্চকণ্ঠ ছিল ঠিকই, এর পাতায় দুঃসাহস ও স্পর্ধা একটু বেশি পরিমাণেই প্রকাশ পেয়েছে। ব্যক্তিগত কবিতার চেয়ে এই পত্রিকার দলবদ্ধ সংহতি এক সুদূরপ্রসারী আলােড়ন তুলেছিল। এর ফলে তরুণ সমাজের মধ্যে কবিতার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃত্তিবাসের জন্মের আগে বাংলা কবিতা পূর্ববর্তী কয়েক বছর ধরে রক্তাল্পতায় ভুগছিল। কৃত্তিবাস সেই অসুখ সারিয়ে তুলে কাব্যরচনায় জোয়ার এনেছে। তার এই ভূমিকা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। কৃত্তিবাস নামটির সঙ্গে বাংলা আধুনিক কবিতার একটি দীর্ঘ পর্বের ইতিকথা জড়িয়ে আছে। বহু কবির আকাঙক্ষা ও জেদ, স্বপ্ন ও স্বেদ মিশে আছে এর পাতায় পাতায়। লিটল ম্যাগাজিনের দীর্ঘ জীবনযাপন মানায় না। নিতান্ত শৈশবে কিংবা ভরা যৌবনে নিঃশব্দে হারিয়ে যাওয়াই যেন তার বিধি। এদিক থেকে দেখলে কৃত্তিবাস-এর পঞ্চাশ বছর এক বিরল ঘটনা। বিচিত্র সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিচ্ছিন্ন এবং অনিয়মিত প্রকাশনা এবং কখনও কখনও কয়েক বছরের জন্য উধাও হয়ে গেলেও এই পত্রিকা আজও প্রকাশিত হচ্ছে। এবং অদূর ভবিষ্যতেও একেবারে মৃত্যুর কোনও সম্ভাবনা। নেই। এই প্রজন্মের পাঠকদের জন্য সময়জয়ী কৃত্তিবাস-এর পুরনাে পাতা থেকে নির্বাচিত রচনা সংকলিত হল।
Title
কৃত্তিবাস পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত সংকলন ১ (সময়জয়ী কৃত্তিবাস-এর পুরনাে পাতা থেকে নির্বাচিত রচনা সংকলন)
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।