”সুন্দর রহস্যময়”বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপ এর লেখা: সুন্দর শুধুই রহস্যময় নয়, রহস্যময় বলেই হয়তাে সুন্দর এমন সৌন্দর্যময়ও। একজন কবি যেভাবে সুন্দরকে অন্বেষণ করেন, একজন চিত্রী নিশ্চিত সেভাবে নয়। তেমনই, দু-জন কবির দৃষ্টিকোণেও থাকে মৌল প্রভেদ, প্রকাশভঙ্গিতে থাকে ব্যবধান। থাকে, কেননা সুন্দর রহস্যময়। থাকে, তাই সুন্দর রহস্যময়। এই কাব্যগ্রন্থের দুই মলাটের মধ্যে সুন্দরের। অনুসন্ধান ও অনুসরণের, অনুধ্যান ও প্রতিষ্ঠার এক দুর্লভ পরিচয়। মূলত, এ-যুগের দুই প্রধান। কবির দীর্ঘ কবিতার সংগ্রহ এই বই। তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ-কালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক চিত্রীর এমন অসামান্য কিছু শিল্পকর্ম, যা নিছক অলংকরণ নয়। কবিতার অন্তস্থল থেকে অন্তঃসারটুকু হেঁকে নিয়ে নীরদ মজুমদার রচনা করেছেন এমন স্বতন্ত্র এক শিল্প, যার আরেক নামও কবিতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার তিনটি দীর্ঘ কবিতায় ফুটিয়েছেন জীবনযাপনের পাশাপাশি এক অদেখা জীবনের ছবি। গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে ভারতবর্ষের পটভূমিকায় স্থাপন করেছেন তিনি। তার অনুভব ও উপলব্ধিকে, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাকে। চিৎপুরের সুড়ঙ্গ, চীনেপাড়ার গােলকধাম, সােনাগাছি, ওয়াটগঞ্জ ঘুরে তার কৈশাের-ভাঙার নেশা, পীরজাঙ্গাল পেরিয়ে শ্যামনগর, আর মানিকচকের খাল পেরিয়ে ঐতিহাসিক চিত্রের মতাে এক গ্রামের বর্ণনা, ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাড়িয়ে তার পথ হারিয়ে ফেলা—এক অনন্য জগতে নিয়ে যায় পাঠককে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ তিনটি কবিতায় কেবলই নিজেকে খোঁড়া। এ আরেক জীবনযাপনের ছবি। রক্ত-মাখা, ব্লীচিং পাউডারের গন্ধমাখা তুলাের মধ্যে এক ভয়ংকর ভয়-ভয় অনুভব, যা থেকে আসে মৃত্যুবােধ, আবার তারই পাশাপাশি এক প্রবল ভালােবাসার পিছুটান। সে-ভালােবাসায় মিশে থাকে পর্তুগীজ চাঁদ, আলতাপাটি শিমলতা, শালুকের ঘুমন্ত ফুল, মন্থর জলের উপর মেঘের ছায়া, টিলার উপরের এক অলৌকিক বাড়ি, খাড়া মানুষের মতাে বেঁচে-থাকার সাধ এবং কবিতার মােহমায়া। স্বাদে-রূপে-রসে এক আশ্চর্য বই—‘সুন্দর রহস্যময়।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।