নির্বাচিত হিন্দী গল্প প্রসঙ্গে প্রেমচন্দের পর হিন্দী প্রগতিশীল ধারা পরবর্তীকালের গল্পেও দেখা যায় । প্রেমচন্দ শেষ জীবনে ‘পুষ কী রাত’ এবং ‘কফন’-এর মত প্রগতিবাদী গল্পও হিন্দী সাহিত্যকে উপহার দেন। এর পরেই প্রগতিশীল লেখা প্রায় জোয়ারের মত উপচে পড়ে। সে ধারার সঙ্গে বেচন শর্মা উগ্র, শিউপূজন সহায়, যশপাল, নাগার্জুন, ভীষ্ম সাহনী, গিরীশ আস্থানা, অমৃত রায়, ভৈরবপ্রসাদ গুপ্ত প্রমুখ এসে যুক্ত হন। পক্ষান্তরে, মনোবিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে এমন কিছুসংখ্যক কথাশিল্পী আবির্ভূত হন – যাঁরা কেবল নারী মনোবিশ্লেষণ, অবচেতন মনের রহস্যময়তা ইত্যাদি কেন্দ্র করে লেখেন। জৈনেন্দ্র কুমার, উপেন্দ্রনাথ অশ্ব, মহাদেবী ভার্মা, সচ্চিদানন্দ হীরানন্দ বাৎসায়ন ‘অজ্ঞেয়’ এই দলের। এর পর, পঞ্চাশ দশক শেষ হতে হতে হিন্দী গল্প-লেখকদের এক দীর্ঘ সারি এসে দাঁড়ায় যাঁরা কেবল মনোবিজ্ঞান কেন্দ্র করে নয়, বরং এইসঙ্গে জনজীবনে ব্যক্তিগত ও সামাজিক যথার্থতাকে কেন্দ্র করে সংখ্যাতীত গল্প লেখেন। মাঝে মাঝে যাকে কেন্দ্র করে ঝড় ও আলোচনা হয়েছে। বাস্তবজীবন থেকে শুরু করে, গ্রাম, শহর ও মহানগরের সমস্যা এনে হাজির করেন। এই সময়কার গল্পকে ‘নঈ কহানিয়াঁ' নামে আখ্যা দেওয়া হয়। মোহন রাকেশ, রাজেন্দ্র যাদব, কমলেশ্বর এই নঈ কহানিয়াঁর জনকত্রয়ী, কিন্তু এঁদেরই সঙ্গে সমান্তরালে অমরকান্ত, শেখর জোশী, নির্মল ভার্মা, শানী, ধর্মবীর ভারতী, মার্কণ্ডেয়, ঊষা প্রিয়ম্বদা, শৈলেশ মাটিয়ানী, ফণীশ্বরনাথ রেণু, মন্নু ভাণ্ডারী, রামকুমার, হৃদয়েশ, মধুকর গঙ্গাধর উৎকৃষ্ট গল্প রচনা করেছিলেন। ষাট দশক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আরও কিছু গল্প- লেখক আবির্ভূত হন, যাঁরা সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে আসেন এবং ‘ষাটোত্তরী সম্প্রদায়' নামে পরিচিত। আগেকার লেখা গল্প থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পটভূমি এবং কথ্যভাষায় তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল। পরে এতেও ভাঙন ধরে, এবং এই সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে প্রচলিত হয়, যেমন – সচেতন কহানী, প্রগতিবাদী কহানী, প্রয়োগবাদী কহানী, অ-কহানী, সহজ কহানী ইত্যাদি। এইসব আন্দোলন থেকে যে সকল গল্প- লেখক উঠে এসেছেন, তাঁরা হলেন – - কাশীনাথ সিংহ, দুধনাথ সিংহ, রমেস বক্সী, সুদর্শন চোপড়া, রাজকমল চৌধুরী, জ্ঞানরঞ্জন, অবধ নারায়ণ সিংহ, রবীন্দ্র কালিয়া, মহেন্দ্ৰ ভল্লা, মহীপ সিংহ, মমতা অগ্রবাল (কালিয়া), সুধা অরোড়া এবং আরো অনেকে। অর্থাৎ সত্তর দশক অবধি এই আন্দোলন দারুণ জোরদার থাকে। এবং বিষয়-বৈচিত্র্য স্পষ্টভাবে গল্প স্পর্শ করে। ফ্যান্টাসি, ব্যর্থতাবোধ, সেক্স, মনোবিজ্ঞান এইসব ছিল এঁদের প্রমুখ মালমসলা। এঁদের সাহিত্য ধারণা পাশ্চাত্য সাহিত্য প্রভাবিত এমন বলা হয়ে থাকে, যদিও তা ভুল। এই দশকের গল্প কেন্দ্র করে আবার বিরোধ উপস্থিত হয়েছে, এবং নতুন কথাশিল্পীরা নিজস্ব নতুন ভূমির অন্বেষণ করছে। এঁদের অন্বেষণ এখনও শেষ হয়নি। এঁরা ব্যবস্থা-বিরোধী, সর্বহারা শ্রেণীর সমর্থনে গল্প তৈরি করছেন। নতুন গল্প-লেখকদের মধ্যে কামতানাথ, সে: রা. যাত্রী, ইব্রাহীম শরীফ, রমেশ উপাধ্যায়, হিমাংশু জোশী, বল্লভ সিদ্ধার্থ, জিতেন্দ্র ভাটিয়া, মধুকর সিংহ, সতীশ জমালী, নিরুপমা সেবতী, মৃদুলা গর্গ, গোবিন্দ মিশ্র, বিভুকুমার, রাকেশ বৎস, মার্কণ্ডেয় সিংহ, অনয় উল্লেখযোগ্য। প্রাগুক্ত হিন্দীর এত গল্প-লেখকদের মাঝ থেকে আঠারো (জন গল্প-লেখক, বাছাই করে (তাও অন্য ভাষায়) বাংলা সাহিত্যে হাজির করা বেশ কষ্টকর ব্যাপার । তবুও এই দুঃসাধ্য কাজে ব্রতী হয়েছি। আসলে আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছি, কারণ আমার মনে বহুকাল যাবৎ একটা দুঃখ চাপা ছিল যে হিন্দীর নামকরা আলোচিত গল্প-লেখকদের বাংলা সাহিত্যের সাহিত্যিক, মনীষী, চিন্তাবিদ এবং পাঠককুলের কাছে হাজির করি। বাংলার কিছু গল্প-লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, আলাপ-আলোচনায় আমি বুঝতে পারি বাংলার গল্প-লেখক এবং পাঠককুল হিন্দী সাহিত্যজগৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, পক্ষান্তরে হিন্দী সাহিত্যজগৎ বাংলার প্রতিটি সীমারেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। যেহেতু, আমার যোগাযোগ বাংলা গল্প-লেখকদের সঙ্গেই নয়, বরং সাহিত্যের সঙ্গেও আছে তাই আমি এই মহান দায়িত্ব গ্রহণ করতে সাহস করেছি। গল্প-লেখকদের বাছাই করার সময় আমি কোনও জেনারেশান বা আন্দোলনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে গল্প-লেখকদের রচনাক্ষমতা, চিন্তাশীলতা এবং কথাসাহিত্যে তাঁদের অবদানের দিকে বেশি লক্ষ্য দিয়েছি। অর্থাৎ, পঞ্চাশ দশক থেকে নিয়ে সত্তর দশক অবধি জোয়ারের মত উপচে পড়া এবং প্রতিষ্ঠিত ঐসব গল্পকারদের আমি নিয়েছি, যাঁরা তাঁদের সময়, মস্তিষ্ক এবং পরিশ্রম কেবল গল্পরচনার প্রতি খরচ করেছেন এবং মূল্যরূপে গল্প-লেখক হিসেবে অভিহিত হয়েছেন। এঁদের আসন কথাসাহিত্যে সর্বোপরি। এঁদের মধ্যে অনেকে সম্পাদক এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধকার হিসেবেও আছেন। কিন্তু মুখ্যত কোনও প্রকারের কবি, নাট্যকার বা সমালোচক নন । পরিশেষে, বাংলা সাহিত্যের গল্পকার ও বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, যিনি আমার এই পরিকল্পনা স্বীকার করে একে পূর্ণ রূপ দিয়েছেন এবং বাঙালী পাঠককুলকে হিন্দী সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত করার প্রত্যক্ষ সুযোগ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য সুধী অনুবাদকদের এবং প্রুফ দেখে দেওয়ার জন্য আমার সহকর্মী স্নেহভাজন বিমলকুমার পালকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই ।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।