"রবিজীবনী ২য় (১২৮৫-১২৯১)" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: একজন অমৃতপুত্রকে আমরা তখনই আবার সহজভাবে তাঁর মর্ত্যরূপে ভাবতে পারি, যখন সময়ের ব্যবধানে অনেক অবান্তর সঞ্চয় ঝরে পড়ে, আবার সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হবারও বাধা থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে তাই অপেক্ষা করতে হবে, হয়তাে দীর্ঘকাল—অন্তত যতদিন-না ‘রবীন্দ্রজীবনী’ পরিবর্ধিত হবার পরেও নতুনতর তথ্য নিয়ে অনুরূপ গ্ৰন্থ আরও বেরােয়।”—চল্লিশ বছর আগে সেই-যে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সেই অপেক্ষারই যেন যােগ্য অবসান ঘটালেন। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী গ্রন্থে। নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, নবতর তথ্যের মিশেল ঘটিয়ে, যুক্তিসিদ্ধভাবে যাবতীয় তথ্যকে যাচাই । করে, একটির-পর-একটি খণ্ডে তিনি তুলে ধরে। চলেছেন এ-যাবৎ অনাবিষ্কৃত এক মর্ত্যরূপী রবীন্দ্রনাথকে। উচ্ছাসের বাষ্পে অস্পষ্ট নয় সেই মুর্তি, কবিকৃত ভাষ্যে খণ্ডিত নয় তার স্বরূপ। কবিকেও যে জীবনচরিতে খুঁজে পাওয়া সম্ভব,সেকথা জানাতেই প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী। ‘রবিজীবনী’র দ্বিতীয় খণ্ড ১২৮৫ থেকে ১২৯১ (১৮৭৮-১৮৮৫) পর্যন্ত রবীন্দ্রজীবনের সাতটি বছরের অনুপুঙ্খ বিবরণ । তিনি আই. সি. এস. পরীক্ষা দেবার ঘােষিত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথমবার বিলাত-যাত্রা করেছিলেন, সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কিন্তু যে মূর্তিকারের হাতে বাংলাদেশের মাটি দিয়ে তাঁর চেহারার আদল গড়ে উঠেছিল, বিলাতে পৌঁছে তাতে আরম্ভ হল ‘বিদিশি কারিগরি'। প্রচলিত প্রথা ও সংস্কারের বিপরীতে চলার শুরু তখন থেকেই। য়ুরােপ-যাত্রী কোন বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ জ্যেষ্ঠাগজ দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্কে-বিতর্কে মুখর হয়ে উঠেছিল, বর্তমান পর্বে। তার শেষ হয়েছে সাহিত্যাগ্রজ বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে ‘সত্যের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক-বিরােধিতার উত্তেজনায় । অন্যের দ্বারা নিরূপিত ‘সত্য’কে তিনি গ্রহণ করবেন না, নিজের বিচারবুদ্ধি-অনুভবে তাকে উদ্বোধিত করে নেবেন নিজের ও সকলের মধ্যে—তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার তখনই সূত্রপাত। এরই মধ্যে তিনি প্রথাগত রাগরাগিণীকে ভাব প্রকাশের কাজে লাগিয়েছেন, কবিতায় প্রবর্তিত করেছেন হৃদয়ের ছন্দ নতুন বউঠান। কাদম্বরী দেবীর রুচির আনুগত্য করতে গিয়ে যেটুকু বন্ধন মেনে চলতে হত, তাঁর বেদনাদায়ক আত্মহনন সেই শৃঙ্খল থেকেও মুক্তি দিয়েছে রবীন্দ্রনাথকে—কৈশােরের ‘হৃদয়ারণ্য থেকে উত্তরণ ঘটেছে যৌবনের রাজপথে।
Proshantokumar Paul-এর জন্ম ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫ (১৮ মে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। কলকাতায়। শৈশব কেটেছিল কৃষ্ণনগরে, প্রাথমিক পড়াশোনা এ. ভি. স্কুলে। কৈশোর ও যৌবন কলকাতারই স্কুলে-কলেজে। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে বাংলায় অনার্স নিয়ে বি-এ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এম-এ পাশ করেছেন ১৯৬০ সালে। ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা শুরু করেন কলকাতার আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা করতে করতেই রবীন্দ্রজীবনের বিবর্তনের সঙ্গে মিলিয়ে ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্ররচনা পড়তে গিয়ে অনুভব করেন যে, রবীন্দ্রজীবনীর এক বিশাল অংশ তমসাবৃত অবস্থায় রয়েছে। উৎসাহী হয়ে শুরু করেন। গবেষণা, অবশ্য ডিগ্রি-প্রত্যাশার বাইরে দাঁড়িয়ে। ১৯৭২ থেকে সেই নবতর গবেষণার সূচনা। ১৯৮২-তে ‘রবিজীবনী’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রকাশমাত্রই এ-গ্রন্থ সর্বস্তরে তোলে আলোড়ন। ১৯৮৪-তে বেরোয় দ্বিতীয় খণ্ড। একইভাবে সমাদৃত হয় এই নতুন খণ্ডও। ১৯৮৫ সালে ‘রবিজীবনী’র জন্য দুটি বিশিষ্ট পুরস্কার পান। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাস পুরস্কার ও সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার। বিশ্বভারতীতে আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থা প্রবর্তিত অশোককুমার সরকার স্মৃতিবৃত্তির প্রথম প্রাপকরূপে ১৯৮৫ সাল থেকে তিন বৎসর শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে গবেষণা করে প্রশান্তকুমার ১৯৯৩-এর। শেষ থেকে সেখানকার অধ্যাপক পদে কাজ করেছেন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটুট তাঁকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে সম্মানিত করেছেন। ২০০১-এ পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার রবিজীবনী সপ্তম খণ্ডের জন্য।