‘একজন অমৃতপুত্রকে আমরা তখনই আবার সহজভাবে তাঁর মর্ত্য-রূপে ভাবতে পারি, যখন সময়ের ব্যবধানে অনেক অবান্তর সঞ্চয় ঝ’রে পড়ে, আবার সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হবারও বাধা থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে তাই অপেক্ষা করতে হবে, হয়তো দীর্ঘকাল—অন্তত যতদিন-না ‘রবীন্দ্রজীবনী’ পরিবর্ধিত হবার পরেও নতুনতর তথ্য নিয়ে অনুরূপ গ্রন্থ আরো বেরোয়।’- চল্লিশ বছর আগে সেই-যে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সেই অপেক্ষারই যেন যোগ্য অবসান ঘটালেন প্রশান্তকুমার পাল, তাঁর ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থে। নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, নবতর তথ্যের মিশেল ঘটিয়ে, যুক্তিসিদ্ধভাবে যাবতীয় তথ্যকে যাচাই করে, একটির-পর-একটি খণ্ডে তিনি তুলে ধরছেন এ-যাবৎ অনাবিষ্কৃত এক মর্ত্য-রূপী রবীন্দ্রনাথকে। উচ্ছ্বাসের বাষ্পে অস্পষ্ট নয় সেই মূর্তি, কবিকৃত ভাষ্যে খণ্ডিত নয় তার স্বরূপ। কবিকেও যে জীবনচরিতে খুঁজে পাওয়া সম্ভব, সে-কথা জানাতেই প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’। ‘রবিজীবনী’র এই তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ১২৯২-১৩০০ (১৮৮৫-৯৪) পর্যন্ত ন-বৎসরের সময়সীমায় ধৃত রবীন্দ্রনাথের এক সর্বাঙ্গীণ জীবনী। যখন তাঁর সাহিত্যবোধ হয়ে উঠছে পরিণত, ছন্দ ও ভাষার উপর অর্জিত হচ্ছে ক্রমারোহী আধিপত্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সচেতনতা হচ্ছে সুবিস্তৃত—সেই সময়ের। একদিকে তখন আর্য-উত্তরাধিকারের মোহে আচ্ছন্ন উগ্র হিন্দুয়ানা, অপরদিকে রাজনৈতিক নেতাদের ‘আবেদন আর নিবেদনের থালা’ নিয়ে রাজশক্তির কৃপাভিক্ষা। আর রবীন্দ্রনাথ? জনপ্রিয়তার জোয়ারে গা না-ভাসিয়ে দুটি ধারার বিরুদ্ধেই তিনি ঘোষণা করেছেন তাঁর বিদ্রোহ। ফলে, সমকালীন বাংলাদেশে রীতিমতো বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব তিনি। ‘সাধনা’ পত্রিকা যেন তাঁর মহাবিদ্রোহের কুঠার। এই সময়েই জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয় উঠছে গড়ে। সেই পরিচয় প্রতিফলিত হচ্ছে ‘সোনার তরী’তে, হচ্ছে নানান অবিস্মরণীয় ছোটগল্পে। অখ্যাত-অজ্ঞাত-অবজ্ঞাত মানবের প্রতিচ্ছবি সেই প্রথমবার দেখা দিচ্ছে বাংলা সাহিত্যে। ‘রবিজীবনী’র তৃতীয় খণ্ডে এই রবীন্দ্রনাথকেও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন প্রশান্তকুমার।
Proshantokumar Paul-এর জন্ম ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫ (১৮ মে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। কলকাতায়। শৈশব কেটেছিল কৃষ্ণনগরে, প্রাথমিক পড়াশোনা এ. ভি. স্কুলে। কৈশোর ও যৌবন কলকাতারই স্কুলে-কলেজে। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে বাংলায় অনার্স নিয়ে বি-এ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এম-এ পাশ করেছেন ১৯৬০ সালে। ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা শুরু করেন কলকাতার আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা করতে করতেই রবীন্দ্রজীবনের বিবর্তনের সঙ্গে মিলিয়ে ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্ররচনা পড়তে গিয়ে অনুভব করেন যে, রবীন্দ্রজীবনীর এক বিশাল অংশ তমসাবৃত অবস্থায় রয়েছে। উৎসাহী হয়ে শুরু করেন। গবেষণা, অবশ্য ডিগ্রি-প্রত্যাশার বাইরে দাঁড়িয়ে। ১৯৭২ থেকে সেই নবতর গবেষণার সূচনা। ১৯৮২-তে ‘রবিজীবনী’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রকাশমাত্রই এ-গ্রন্থ সর্বস্তরে তোলে আলোড়ন। ১৯৮৪-তে বেরোয় দ্বিতীয় খণ্ড। একইভাবে সমাদৃত হয় এই নতুন খণ্ডও। ১৯৮৫ সালে ‘রবিজীবনী’র জন্য দুটি বিশিষ্ট পুরস্কার পান। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাস পুরস্কার ও সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার। বিশ্বভারতীতে আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থা প্রবর্তিত অশোককুমার সরকার স্মৃতিবৃত্তির প্রথম প্রাপকরূপে ১৯৮৫ সাল থেকে তিন বৎসর শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে গবেষণা করে প্রশান্তকুমার ১৯৯৩-এর। শেষ থেকে সেখানকার অধ্যাপক পদে কাজ করেছেন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটুট তাঁকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে সম্মানিত করেছেন। ২০০১-এ পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার রবিজীবনী সপ্তম খণ্ডের জন্য।