"পূর্ব-পশ্চিম(২য়)" বইয়ের ভূমিকার অংশ থেকে নেয়া: বিশাল ক্যানভাসে চিত্রিত এই উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ একইসঙ্গে ছুয়ে আছে এপার এবং ওপার বাংলা। শুরু সেই। 'পঞ্চাশের মধ্যভাগে । দু-বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক। ক্ষেত্রের পালাবদলের সােত কীভাবে এসে মিশেছে এই | আশির দশকের মােহনায়, এ-উপন্যাস তার এক জীবন্ত । দলিল। একদিকে নেহরুর মত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, লালবাহাদুরের অকালপ্রয়াণ, ইন্দিরার অভ্যুত্থান, অর্থনৈতিক । ক্রমাবনতি, তরুন সমাজের মধ্যে জেগে-ওঠা বিপ্লবের । আকাক্ষা-উম্মাদনা, উগ্রপন্থী রাজনীতি, বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-যুদ্ধ ; অন্যদিকে ভাষা-আন্দোলনের অব্যবহিত। পরবর্তী সময় গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন। 'বাংলাদেশ মুক্তি-আন্দোলন, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে 'যুবসমাজের হতাশী, মুজিব-হত্যা-এ-সমস্ত কিছুকে ছুয়ে। প্রবাহিত ‘পূর্ব-পশ্চিম'-এর ঘটনাস্রোত। দুই বাংলার দুই। পরিবারকে কেন্দ্র করে রচিত এই উপন্যাস বিশেষ কোনাে। চরিত্রকে মূল চরিত্র বলা যাবে না। একই সঙ্গে অনেকগুলি। প্রধান চরিত্র । এইসব চরিত্রের কেউ-কেউ আবার পূর্ব বা। 'পশ্চিম বাংলার গণ্ডিতেই আবর্তিত নয়, ইউরােপ - আমেরিকাতেও গেছে। ফলে কলকাতার কফি হাউসের। পাশাপাশি কখনাে পুর বাংলার কাদা-প্যাচপেচে গ্রাম কখনাে। আবার আমেরিকার চোখ ধাঁধানাে শহরের কথা এই। উপন্যাসে । 'পূর্ব-পশ্চিম'-এই নামকরণেও যেন নিহিত ত্রিমাত্রিক। ব্যঞ্জনা। এ-উপন্যাসে শুধুই পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার কথা নয়।। পূর্ব গােলার্ধ ও পশ্চিম গােলার্ধের বৃহত্তর পটভূমিও এর। অন্তর্গত। আবার মানুষের জীবন ও মনে যে পূর্ব ও পশ্চিম, তার উচ্চাকাক্ষা ও উত্থান-পতন, সূচনা ও দিনাবসান-তাও | যেন সুক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত এই নামকরণে। 'এই সময়'-এর। লেখকের কলমে এই সময় নিয়ে লেখা ‘পূর্ব-পশ্চিম বাঙালী। জীবনের আধুনিক গদ্য মহাকাব্য ।। দু-খণ্ডে সমাপ্ত এই উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের মতাে দ্বিতীয় । 'খণ্ডেও দুটি পর্ব। উত্তরপূর্ব ও উপসংহার । উত্তরপূর্ব ও । উপসংহার-এর মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান প্রায় চোদ্দ বছর। ফলে, যে-সমস্ত চরিত্র এই উপন্যাসে, তাদের পরিণতি। সম্পর্কে যে-অনিবার্য কৌতুহল গড়ে ওঠে উত্তরপূর্ব পর্যন্ত । রুদ্ধশ্বাস-গতিতে-ধাবমান এই বিশাল কাহিনীতে, তা । বহুলাংশে তপ্ত হয় উপসংহার-পর্বে পৌছে। দেশবিভাগ নিয়ে তেমন স্মরনীয় উপন্যাস বাংলাভাষায় লেখা | হয়নি। দু-পার বাংলায় ছড়ানাে সমান্তরাল বাঙালীজীবন। নিয়েও না। সেই অপূর্ণতাকেই দূর করল এই বিশিষ্ট, ব্যতিক্রমী ও বড়ে-মাপের উপন্যাস।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।