ভূমিকা ‘একটা মিথ্যা কথা দশবার বললে সেই মিথ্যাটাই সত্য হয়ে যায় আর সত্যটা চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।’ এই প্রবাদটির প্রেক্ষিতেই আমার এই ‘দ্বীপান্তরের বৃত্তান্ত’ গ্রন্থটি লেখা। একটি অমুসলমান সম্প্রদায় হাজারটা মিথ্যাচারের, প্রতারণার আর বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ঈসায়ী সতেরশ’ সাতান্ন সনে এই পাক ভারত বাংলাদেশ উপমহাদেশটি তুলে দেয় ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা এদেশের মালিক হওয়ার পর মুহূর্ত থেকে ঐ সম্প্রদায়টি দেবতাজ্ঞানে ইংরেজদের ভক্তি শ্রদ্ধা ও পূজা করা শুরু করে। এই পূজা ভক্তির বদৌলতে ঐ সম্প্রদায়টি লাভ করে প্রভূত ক্ষমতা, সম্পদ, পদ, পদবী, খেতাব, পুরস্কার এবং ইংরেজদের অনুগ্রহে হয়ে যায় জমিদার ও রাজা মহাজারা। এই সম্প্রদায়টি দেশের সর্বত্রই রাজা-মহারাজা ও জমিদার হয়ে বসে যায় এবং ইংরেজদের পক্ষে ও ইংরেজদের ছত্রচ্ছায়ায় এরাই দেশের শাসককুলে পরিণত হয়। এই অপরিসীম অনুগ্রহ লাভের কৃতজ্ঞতায় গদ গদ হয়ে ইংরেজদের তারা তাদের ‘ভাগ্যবিধাতা’ বলে অভিহিত করে এবং ইংরেজদের বন্দনায় তারা সকাল-সন্ধ্যা মুখরিত হয়ে উঠে।
অথচ হাস্যকর ব্যাপারটা হলো এই যে, ইংরেজরা এদেশ দখল করার পর থেকে এই দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর জন্যে এই অমুসলমান সম্প্রদায় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে এবং দীর্ঘকাল যাবত ইংরেজদের তাড়ানোর সংগ্রামে প্রাণপাত করেছে মর্মে এরা একের পর এক মিথ্যা কাহিনী রচনা করেছে এবং আজও করে চলেছে। এইসব মিথ্যা কাহিনীর মধ্যে তারা তুলে ধরেছে, ইংরেজদের তাড়ানোর জন্যে একমাত্র তারাই দীর্ঘকাল যাবত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে, তারা ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায় বা কোন কেউই ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটা আঙ্গুলও তুলেনি।
এদের এই কল্পিত কাহিনীর বিপরীতে আসল ইতিহাস হলো এই যে, ঈমানদার শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়, অর্থাৎ মুসলিম মনীষীরা, ইংরেজরা এদেশ দখল করার পর মুহূর্ত থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুর্বার সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং ঈসায়ী সতেরশ’ সাতান্ন সন থেকে আঠারশ’ সনের শেষভাগ পর্যন্ত লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে নেমে লাখ লাখ মুসলিম মনীষী মৃত্যুবরণ করেছে, লাখ লাখ মুসলিম মনীষী ইংরেজদের দ্বারা অমানুষিক ও পাশবিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে, জেল ফাটক খেটেছে, লাখ লাখ মুসলিম মনীষী ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছে, লাখ লাখ মুসলিম মনীষী দ্বীপান্তরে গিয়েছে।
অথচ এই দিবালোকের মতো সত্য ইতিহাসের ছিটে-ফোঁটাও ঐ অমুসলমান সম্প্রদায়ের কল্পকাহিনীর মধ্যে আসেনি। আগামী প্রজন্মের কাছে ওদের এই মিথ্যাটাই যাতে করে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং সত্য ইতিহাসটা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে না যায়, এই উদ্দেশ্যেই এই ‘দ্বীপান্তরের বৃত্তান্ত’ গ্রন্থটি আমার লেখা। এই গ্রন্থের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের সামনে কল্পকাহিনীকারদের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসুক আর মুসলিম মনীষীদের অকাতর ও হৃদয়বিদারক আত্মদানের বিষয় অবগত হয়ে দু’ফোঁটা চোখের পানি না ফেলুক, আগামী প্রজন্ম এই মনীষীদের স্মরণে অন্তত একটু শ্রদ্ধাবনত হোক, এই কামনা করি। আমিন। শফীউদ্দীন সরদার