আমরা কাব্যসৌন্দর্যের মৌলবস্তুর আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি। এই প্রসঙ্গে বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করছি মানবসমাজে শব্দার্থের আবির্ভাবক্ষণটিকে, আর নিঃশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি সেই পূর্বাচার্যগণের উদ্দেশে, যাঁরা ব্যাকরণ, ন্যায়, মীমাংসা, অলংকারশাস্ত্র এবং কাব্যাদি বিরচনের দ্বারা সারস্বত বুদ্ধির জাগরণ ও প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর করেছেন। সার্থক শব্দ হচ্ছে বাক্যের উপাদান এবং নরলোকে মনোভাব প্রকাশের প্রাথমিক উপায়। আবার, শব্দ বলতে বর্ণগোচর ধ্বনি বা ধ্বনির সমষ্টি বোঝায়। মনুষ্যমুখোচ্চারিত ভাবপ্রকাশক এই ধ্বনিই হ'ল বাক্। অর্থের সঙ্গে এর নিয়ত সম্বন্ধ। বাক্-এর অতিগুরুত্ব অনুধাবন ক'রে একে সমাজে পূজ্য দেবতার স্থান দেওয়া হয়েছে। আবার এই বাক্ যাতে দুষ্ট না হয় সে বিষয়ে সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে পুনঃপুন। কারণ, বাক্ দুষ্প্রযুক্ত হ'লে মানুষের ভাবনা ও কার্যের সামঞ্জস্য বিঘ্নিত হবে, লোকযাত্রা অচল হয়ে পড়বে। আলংকারিক দণ্ডী নরলোকে শব্দের নিতান্ত প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলছেন ঃ ইদমন্ধতমঃ কৃৎস্নং জায়েত ভুবনত্রয়ম্। যদি শব্দাহ্বয়ং জ্যোতিরাসংসারং ন দীপ্যতে ॥ শব্দাখ্য জ্যোতি যদি সংসার আলোকিত না করত তাহলে ত্রিভুবন অন্ধতমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ত, মানুষের জীবনযাত্রা চলত না। এই 'শব্দের যথাযথ ব্যবহার কত গুরুত্বপূর্ণ তা জানাতে গিয়ে শব্দশাস্ত্রবিৎ প্রাচীনতর মনীষী বলেছেন : একঃ শব্দঃ সুপ্রযুক্তঃ সমজ্ঞাতঃ স্বর্গে লোকে চ কামধুগ্ ভবতি। একটি শব্দেরও শক্তি যদি সম্যক্ জানা যায় এবং শব্দটিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায় তাহ'লে ইহলোকে এবং পরলোকে তা কামধেনুর মতো ইচ্ছাপূরণ করে। মানুষের সমুদয় ভাববিবৃতিতে শব্দের তথা বাক্যের শুদ্ধপ্রয়োগ নির্ণয় করার ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য রয়েছে ব্যাকরণ, কোষগ্রন্থ এবং ন্যায় ও মীমাংসা শাস্ত্র। কাব্যে ব্যবহারযোগ্য বাক্-এর সুপ্রয়োগ ও সুষমাময় প্রয়োগের নির্দেশক অলংকারশাস্ত্র রচিত হয়েছে। বস্তুত সংসারযাত্রার প্রয়োজনে, চিন্তার বিন্যাসব্যাপারে শব্দের ও বাক্যের যা ব্যবহার, তা থেকে কাব্যনির্মাণে শব্দের ও বাক্যের ব্যবহারের রীতি বহুলাংশে পৃথক। কাব্যের ভাষা আবার কবিব্যক্তি অনুসারে এবং দেশ-কালে পরিবর্তিত হয় । কাব্য শ্রোতা বা পাঠকের অন্তরে যে-সৌন্দর্যানুভব বা আম্বাদবিশেষ জন্মায় তা সহৃদয়ের অনুভববেদ্য হলেও এর নির্মাণকৌশল বিচারের দ্বারা জ্ঞেয় এবং কাব্যবোধও প্রায়শই শিক্ষা ও শাস্ত্রজ্ঞানের অপেক্ষা রাখে।
Dr. Khudiram Das জন্ম ৯ অক্টোবর ১৯১৬ বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া। মৃত্যু ২৮ এপ্রিল ২০০২ কৃষ্ণনগর, নদীয়া। শিক্ষাজীবন কেশবচন্দ্র মণ্ডলের পাঠশালা, বেলিয়াতোড় মধ্য ইংরেজি স্কুল, বাঁকুড়া জেলা স্কুল, বাঁকুড়া ওয়েলিয়ান মিশন (একালের ক্রিশ্চিয়ান) কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সংস্কৃত অনার্সে প্রথম শ্রেণি (১৯৩৭)। এম.এ. বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম (১৯৩৯)। স্বর্ণ ও রৌপ্যপদকে ভূষিত। বি.টি. (১৯৪১)। সংস্কৃত আদ্য, মধ্য, কাব্যতীর্থ ও কাব্যরত্ন উপাধি অর্জন। কর্মজীবন : স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মজীবন শুরু (১৯৪২)। অধ্যাপনা (১৯৪২-১৯৮১) স্কটিশচার্চ কলেজ, কলকাতা উইমেন্স কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ, কৃষ্ণনগর কলেজ, মৌলানা আজাদ কলেজ, হুগলি মহসীন কলেজ, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। (১৯৭৩-১৯৮১)। শেষোক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রচিত গ্রন্থ:রবীন্দ্র-প্রতিভার পরিচয় (১৯৫৩), বাংলা কাব্যের রূপ ও রীতি (১৯৫৮), চিত্রগীতময়ী রবীন্দ্রবাণী (১৯৬৬), বৈষ্ণব-রস-প্রকাশ (১৯৭৩), সমাজ প্রগতি রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৮), রবীন্দ্র কল্পনায় বিজ্ঞানের অধিকার (১৯৮৪), বাংলা বানানের বন্দরে (১৯৯৪), ১৪০০ সাল ও চলমান রবি (১৯৯৪), দেশ-কাল-সাহিত্য (১৯৯৫), সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান (১৯৯৮), বাছাই প্রবন্ধ (২০০০)। সম্পাদনা—কবিকঙ্কণ-চণ্ডী (১৯৭৬)।