কর্মহীন পুরুষের সঙ্গে একমাত্র নিঃসন্তান নারীর তুলনা চলতে পারে। সংসারে প্রয়ােজনের নিরিখে দুজনেই যেন তুল্যমূল্য। আছ ভালাে, না থাকো তাে তেমন একটা ক্ষতি-বদ্ধি নেই। সন্তানহীনা নারীর যেমন সাংসারিক কাজকর্মের ক্ষমতাটুকুই কেবল সম্বল, তেমনি এই অবসরপ্রাপ্ত কর্মহীন পুরুষের একমাত্র সম্বল কেবল এই পেনশনের টাকা ক’টা—ডিভ্যালুয়েশন হতে হতে যার আসল মূল্য এখন নামমাত্রে এসে দাঁড়িয়েছে। মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে এই অবসরপ্রাপ্ত বন্ধেরা এখানে আসেন তাঁদের বেপেনশনের টাকা নিতে। এই একটা দিন তাঁরা তাঁদের সংসারে ভি আই পি, না হােক অন্তত আই. পি অর্থাৎ ইম্পটেন্ট পাসন। সকালে উঠেই পকেশে কিংবা টাক মাথায় তেল-জল দিয়ে জামাকাপড় পরে পেনসন কার্ডখানা সাবধানে পকেটে ফেলে বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। সেকালের সেই গৌরবােজ্জল দিনের এই সামান্য পুনরাবৃত্তিটুকুই যেন সেই মহতে অসামান্য হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে। অফিসের কাজ-কর্ম চালু হতে সেই এগারােটা সাড়ে-এগারােটা। কিন্তু সকাল ন'টা থেকেই কাউন্টারের সামনে এসে ভিড় করতে থাকেন তাঁরা। বেতাে শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না তাঁদের। বসার জন্যে বেঞ্চির বন্দোবস্ত আছে। মাসের এই নির্দিষ্ট দিনটিতে সেকালের দু'একজন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। বসে বসে হাই তুলতে তুলতে চলে অতীত-রােমন্থন। আবার কোন মাসে তাঁদের মধ্যে কাউকে অনুপস্থিত দেখলেই বুকটা ধক করে ওঠে। মনে পড়ে যায় নিজের বয়সের কথা। প্রতি মাসের তিন তারিখে বদ্ধদের এই লাইনের প্রথম মানুষটি হচেছন একজন অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান বম্ব। ঝড় হােক জল হােক লাইনের প্রথম স্থানটি তাঁর নির্দিষ্ট। এই দীর্ঘ দিনেও কেউ তাকে স্থানচ্যুত করতে পারে নি। মানুষটির বয়স প্রায় সত্তরের কোঠায়, দু'এক বছর বেশিও হতে পারে। রােদে পড়ে জলে ভিজে গায়ের এককালের ফসা রঙ তামাটে হয়ে গেছে। মাথার পাতলা চুল সম্পর্ণ সাদা, দাড়ি-গোঁফ কামানাে, সারা মুখে শিথিল চামড়ার ভাঁজ, কুঞ্চিত চোখের কোণ, প্রশস্ত কপালে বলিরেখার সাবলীল গতিপথ শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। ছ'ফুট দুই ইঞ্চির এই দীর্ঘকায় মানুষটি এককালে যে ঋজু হয়ে লম্বা পা ফেলে বেশ দাপটের সঙ্গেই চলে-ফিরে বেড়াতেন তা তাঁর একালের চালচলনেও বোঝা যায়।