‘কালো ভ্রমর’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ কিরীটী-তত্ত্ব কিরীটী রায় রোমাঞ্চ-অন্বেষী কিশোর মনের চিরন্তন নায়ক। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বাঙালি কিশোর পাঠকমনকে এই সম্ভাব্য-অসম্ভাব্যতার আলোছায়া ঘেরা জগতে মোহমুগ্ধ করে রেখেছে রহস্যভেদী কিরীটি রায়। “প্ৰায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ, বলিষ্ঠ চেহারা। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, ব্যাকব্রাশ করা। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে, সদানন্দ, আমুদে।” এই কিরীটী রায়ের পরিচয়। কলেজজীবনে শখের তাড়নায় যে নেশার শুরু, ক্রমে তাই তার বৃত্তি বা পেশায় পরিণত হয়েছে। ‘কিরাটীর আবির্ভাব’-এ কিরীটী এই কাহিনীত্রয়ীর অন্যতম বিখ্যাত ভ্রাতৃত্ৰয় রাজু সনৎ ও সুব্রতর সঙ্গে পরিচিত হন। এরপরই কালোভ্ৰমর কাহিনীর শুরু। বাংলা-রহস্য কাহিনীর নায়ক কিরাটীর সঙ্গে দুৰ্বত্ত কালোভ্ৰমরও বাঙালি পাঠকচিত্তে স্মরণীয় স্থান পেয়ে গেছে। ‘উত্তেজনা ও আবেগে’ কিরীটীর বুকের মাঝে যখন ‘ঢিবঢিব’ করে ওঠে তখন তার মানসিক সঙ্গী পাঠক কিশোর বা বালকের মনেও এই একই প্রতিক্রিয়া। কাহিনী শেষ করার সঙ্গে কাহিনীর ঊধের্ব জেগে থেকে পাঠকমনে রহস্যকাহিনীর রহস্যভেদী নায়ক কিরীটী রায়ের ব্যক্তিত্ব, তার তীব্রতীক্ষ যুক্তিবোধ, পরিমিতি বোধ, ক্ষুরধার বৃদ্ধির মালিন্যমুক্ত ঔজ্জ্বল্য নিয়ে; যা কিরীটী রায়কে সমসাময়িক ডিটেকটিভ কাহিনীর নায়কদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিয়েছে এবং তার স্রষ্টাকে দিয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রত্যক্ষ সাফল্য। শ্ৰীপ্ৰমথনাথ বিশী
বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটি রায় এর স্রষ্টা এবং জনপ্রিয় রহস্য কাহিনী লেখক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, একইসাথে ছিলেন একজন চিকিৎসকও। একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে দুই বাংলাতেই লাভ করেছেন বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা। ওপার বাংলায় বেড়ে ওঠা ও জীবন কাটালেও তিনি জন্মেছিলেন এপার বাংলায়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় ১৯১১ সালের ৬ জুন বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয় পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রখ্যাত কাহিনীকার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করতে হয়েছে । শেষ পর্যন্ত কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন ও চর্মরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ডাক্তার হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন দেশের রণাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে সেবাদানের পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যার ছাপ পরবর্তীতে পড়েছে নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমূহতে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই লেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই এবং সেই সূত্রে তিনি অনেক কম বয়সেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাজকুমার' রচনা করেন। তবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস এর মধ্যে তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে তাঁর লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস সমূহ, যা রচনা করার আগ্রহ থেকে তিনি ব্রিটেনে অবস্থানকালে সাক্ষাৎ করেন আরেক বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনী রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির সাথে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এর মধ্যে প্রথমটি হলো 'কালোভ্রমর', যেখানে তিনি সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সেরা সৃষ্টি গোয়েন্দা কিরীটি রায়ের সঙ্গে। এছাড়াও নীহাররঞ্জন গুপ্তের রচনাবলী এর মধ্যে 'মৃত্যুবাণ', 'কালনাগ', 'উল্কা', 'হাসপাতাল', অপারেশন', 'কিরীটি অমনিবাস' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই এর সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। আর নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমগ্র এর মধ্যে প্রায় ৪৫টি নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এছাড়াও তিনি 'সবুজ সাহিত্য' নামে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ৭৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।