রাত প্রায় এগারােটা। দূর পাল্লার ট্রেনটি তখন রীতিমতন জোরে ছুটছে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আর কোনাে স্টেশনে থামবে না। ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ক্লাস কামরাগুলােতে বেশির ভাগ আলাে নিভিয়ে শুয়ে পড়িছে যাত্রীরা। থার্ড ক্লাস কামরায় আলাে নেভে না, সেখানেও যাত্রীরা ঘুমে ঢুলছে। অনেকেই শােওয়ার জায়গা পায়নি, এ ওর ঘাড়ে মাথা রেখেছে। একটি কামরায় চার পাঁচ জন এক কোণে বসে তাস খেলছিল। সাধারণত তাস খেলার সময় খুব চেঁচামেচি হয়। যুবা বয়সের ছেলেরা অন্যদের সুবিধে অসুবিধে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু এরা তাস খেলছে প্রায় নিঃশব্দে। ব্রীজ খেলা। ডাকার সময় এরা কথা বলছে মৃদু গলায়, তারপর আবার চুপচাপ। মাঝে মাঝেই এরা খেলা থামিয়ে তাকাচ্ছে পরস্পরের চোখের দিকে, কিংবা ঘড়ি দেখছে। ট্রেনটির শেষে গার্ডের কামরায় গার্ডবাবু বসে বসে একটা গল্পের বই পড়ছেন। তিনি পাঁচ কড়ি’দের গােয়েন্দা কাহিনী পড়তে খুব ভালােবাসেন। ব্রেক ভ্যানে রাইফেলধারী রক্ষী মেঝেতে বসে আছে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। মাঝে মাঝে তার চোখ বুজে আসছে, আবার গা ঝাড়া দিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসছে। ইঞ্জিনে অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান ড্রাইভার তার দু’জন সহকারীর সঙ্গে গল্প-গুজবে ব্যস্ত। তার প্যান্টের পকেট থেকে উঁকি মারছে একটা মদের বােতল। বােতলটির ভেতরের জিনিস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর দু’এক চুমুক বাকি। সবাই জানে ইঞ্জিনের ড্রাইভার ফার্গুসন দু'তিন বােতল খেয়েও একটু টলে না। এক সময় ট্রেনের গতি হঠাৎ মন্থর হয়ে এলাে। কাছাকাছি কোনাে স্টেশন নেই, এখানে ট্রেন থামার কথা নয়। দু’বার শােনা গেল তীব্র হুইশে.....
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।