ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ। পরাধীনতার শৃংখল থেকে বাংলা মাকে মুক্ত করার জন্য ১৯৭১ সালে সাড়ে-সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ করেছে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুরা। সে সময় পুরুষের পাশাপাশি সম্মুখ সমরে ঝাপিয়ে পড়েছে বাংলার নারীরা। শিশু কিশোররাও ঘরে বসে থাকেনি। এক পরিসংখানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রায় চার লাখই ছিলো শিশু কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়ে ছিলো, তাঁদের মধ্যে অর্ধেকই ছিলো কিশোরী। সেই সময়ের অনেক কিশোরী আছেন যারা বীরাঙ্গনা হয়েও আজো রাষ্টীয়ভাবে স্বীকৃতি পাননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবর্ণনীয় কষ্টকর অভিজ্ঞতা হয়েছে যুবতি ও কিশোরীদের। পাক হায়েনাদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে মাসের পর মাস খেয়ে না খেয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে ছুটে বেড়িয়েছে। মান- প্রাণ রক্ষা করতে তাঁরা কখনো মাটির গর্তে, কখনো পাটখড়ির স্তুপে লুকিয়েছে। কখনো আবার সম্মুখ সমরে ঝাপিয়ে পড়েছে। নানা কৌশলে শত্রæ নিধন করে স্বাধীনতার সূর্য চিনিয়ে এনেছে। স্বাধীনতার পর সেই সব বীর নারীদের আরো বেশী কষ্ট সইতে হয়েছে। বাবা মা স্বামী ভাই আত্মীয় স্বজন কেউ তাঁদের পরিচয় দিতে চায়নি। তখন কেউ আত্মহত্যা করেছে, কেউ সারা জীবন দূর্বিষহ দিন কাটিয়েছে। লেখক রাতদিন পরিশ্রম করে একাত্তরের সেই বীর কিশোরীদের খুঁজে বের করেছেন। লিখেছেন তাঁদের গৌরবময় আত্মকথা। তারা বলেছেন, যে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি, ইজ্জত হারিয়েছি সে স্বাধীনতা আমাদের কখনো আসেনি । লাঞ্চনা সইতে সইতে জীবনতো প্রায় চলেই গেলো। আর স্বীকৃতি চাই না। কালক্রমে মিথ্যাও সত্য বলে প্রমানিত হয়। যে সত্য কালের গর্ভে চাপা পড়ে গেছে, সে সত্যকে সামনে এনে নাতি পুঁতির কাছে ঘৃণার পাত্রী হতে পারবো না। এই বয়সে সম্ভ্রম হারানোর কাহিনী আবৃত্তি করে নিজেদেরকে বীর প্রমাণ করতে চাই না। আমরা চাই না, আমাদের সন্তানদের দিকে কেউ আঙুল তুলে বলোক তোর মা ধর্ষিতা। আমরা সবাই দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম প্রতিদান পাওয়ার জন্য নয়। আমার বাংলা মা মুক্ত হয়েছে, মায়ের বুকে বেঁচে আছি এটাই র্স্বাথকতা। মায়ের কাছে কি প্রতিদান চাওয়া যায়?
আনোয়ারা খাতুন এর জন্ম ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার টিকুরিয়া গ্রামে। কর্মজীবনে তিনি আইন পেশাকে বেঁচে নিয়েছেন। প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ আর্তনাদ (২০২০) প্রকাশ করেছে প্রতিভা প্রকাশ। লেখনির বিষয়-অবহেলিত সমাজের নারী ও শিশুদের নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন। একাত্তরের নির্যাতিত কিশোরীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ ‘একাত্তরের কিশোরী’, ২০২১, প্রকাশ করেছে শোভা প্রকাশ। তিনি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। প্রতিনিয়ত বাংলার একপ্রান্থ থেকে আরেক প্রান্থে ছুটে চলেছেন বীরাঙ্গনার খুঁজে। গবেষণার পাশাপাশি লিখছেন, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনী। সাহিত্যের সকল শাখা বিচরণ করছেন গুণি এই লেখক। সম্পাদনা করেন, লিটলম্যাগ ‘অঙ্গজা’। তাঁর নেশা বই পড়া ও লেখা। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের টেনে তুলে বিশ্ব দরবারে সম্মান প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর লেখার মূল উদ্দেশ্য। আজীবন লেখালেখির মধ্যে ডুৃবে থাকতে চান।