রোল নং ১৭ দোলা মিত্র কোয়েল তালুকদারের চতুর্থ গল্প গ্রন্থ। কোয়েল গল্প বলার মানুষ। কোয়েল গল্প লেখার মানুষ। সে দুশতাধিক ছোটগল্পের রচয়িতা। তার রচিত গল্পগুলির মধ্যে আছে মানবজীবনের ছোট বড় দুঃখ ব্যথা বেদনার কথা, আছে প্রকৃতির মধ্যে বিচরণশীল মানুষের অন্তর্গত পরিচয়ের কথা। কল্পনা ও সৌন্দর্যের অনুভূতিতে রহস্যময় জগতের কথাও আছে। এই গ্রন্থে সন্ধ্যার মেঘমল্লার গল্পে এমনই শ্বাশত বাংলার চিরায়ত প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। গল্পে গত শতাব্দীর ত্রিশ দশকের বাংলা ও পল্লী সমাজ জীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। গল্পটি পড়লে মনে হয় যেন বিভূতিভূষণ পড়ছি। একটু উদ্ধৃত করছি – ‘তারপর জীবনে কত কিছু পেলাম। কত ডিগ্রি নিলাম। কত বড় কর্তাব্যক্তি হলাম। কত বড় ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলাম। কত শিক্ষিত সে। কত দেশ ঘুরেছি। কত মানুষ দেখেছি। কত মৌন নদী। কত পর্বতের গাত্রে দেখেছি কত লতাগুল্ম, পাহাড়ি ফুল। কত পূর্ণিমা রাত্রি উপভোগ করেছি। সবকিছুর ভিতর একজন অনাদৃত, একজন উপেক্ষিত, একজন দলিত বিধবা মেয়ের মুখ মনে পড়েছে। কত রাশি রাশি আনন্দের মাঝে, সেই কবেকার কতদূরের এক পল্লীবালা অপার্থিব অশ্রু ঝরিয়ে গেছে আমার জীবনের সকল আনন্দ বেদনার উপর। এখনো কী সন্ধ্যার মেঘমল্লারে সেই অনাদরের সন্ধ্যামণি ফুলটি অশ্রু জলে ভেজে?’ এই বাংলার অকিঞ্চিৎকর গাছপালা, ফলমূল, পশু পাখি, নদী বিধৌত পলিমাটি ও পথের উপরের ধুলোর উপকরণ দিয়ে আপন চৈতন্যের অলৌকিক শক্তি মাধুর্য মিশিয়ে কোয়েল গল্প লিখে গেছে জীবন শিল্পীর মতো। সৃষ্টি করেছেন তার নিজস্ব সাহিত্যলোক। প্রেয়সী নারীর প্রেম প্রাকৃতিক পুষ্প-পত্রের মতোই সহজ ও স্বয়ংপুষ্ট। জীবন জটিলতায় ভারাক্রান্ত এক আনমনা লেখক সে। স্বপ্নলোকের ভারহীন স্বাদ আর অধরা সুরভিতে সমগ্র চেতনাকে অপূর্ব শিল্পশৈলীতে এঁকে গেছেন তার প্রতিটি গল্পে। কোয়েল যেন বাংলা ছোটগল্পের উজ্জ্বল শিল্পদূত। আমাদের এই যানজটের শহরে যখন গাড়ির কর্কশ হর্ন বাজে, শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ হয় মানুষ, তখন আপনি ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তে পারেন কোয়েলের গল্প। দেখতে পাবেন সেখানে − পদ্মা যমুনার কলকলিত ছলাৎছলাৎ জল, নীল আকাশ, উদাস চরাচর, মৌন বটবৃক্ষ। শুনতে পাবেন ভাটিয়ালী গান, ভোরের পাখিদের কিচিরমিচির। আর গন্ধে আকুল হবেন ঘাটফুল ও সোনাল ফুলের সুবাসে। বাংলার মাঠ, নদী, নিরালা বন প্রান্তরের সুমুখ জ্যোৎস্না রাত্রির যে মায়ারূপ কোয়েল অঙ্কিত করেছে তা আসলেই বিস্ময়কর! কোয়েলের লেখা গল্প পাহাড়, নদী, অরণ্যের নির্জনতায় দিকচক্রবালে দীর্ঘ নীল রেখার মতো স্বপ্ন আনে মনে। প্রকৃতি ও মানুষ যেন একই গ্রন্থিতে সৃষ্টি। তার সব গল্পের কথার মালা গাঁথা- একই সুতোয় বাঁধা যেন। সাধারণভাবে তাঁর ভাষা বহুলাংশে কবিতাধর্মী বা কাব্যিক। কোয়েলের লেখায় কখনও অতি রোমান্টিক, কখনও আবার বিরহ বিষণ্ণতার ধূসরতা লক্ষণীয়। তার গল্পে বেদনার্ত প্রেমের রূপ পাওয়া যায়। তাই তিনি কল্যাণ কামনায় নারীকে সর্বোচ্চভাবে সম্মান দেখিয়েছে। কোয়েল তালুকদারের ছোটগল্প পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। ওর লেখা পড়ার পর পাঠক চলে যায় এক স্বপ্নীল জগতে। আর এই কারণেই প্রকৃতিপ্রেমী এই লেখক বাংলা কথাসাহিত্যে একটি আলাদা স্থান করে নেবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।’ - আফজালুল বাসার জনপ্রিয় কথাশিল্পী কোয়েল তালুকদারের ৫ম গ্রন্থ “রোল নং ১৭ দোলা মিত্র” একটি গল্পগ্রন্থ। ১৫৪ পৃষ্ঠায় মোট ২৮টি গল্পের সম্ভার।
তাহার কথা কোয়েল তালুকদারের জন্ম সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পাড়ে কুসুমপুর গ্রামে। ওখানেই তার বেড়ে ওঠা, ওখানেই সে বাল্য ও শৈশবকাল কাটিয়েছে। গ্রামে স্কুল জীবন শেষ করে সে ঢাকায় চলে আসে। সে এসেছিল (তার কথায়) ---' তখন মাঘের শীত। এক সন্ধ্যায় বয়রা ঘাট থেকে বড়ো স্টীমারে উঠিলাম। কুয়াশাচ্ছন্ন যমুনা নদী। নদীতে জল কম। তখন মধ্য রাত্রি। এম.ভি সোহরাওয়ার্দী বড়ো জাহাজখানি বিকট ঝাঁকুনি দিয়া চরে আটকিয়া গেল। সারারাত্রি একটি মার্কিন কাপড়ের গিলাফ গায়ে দিয়া ডেকের ভিতর ঘুমিয়া থাকিলাম। তারপর ভোর হইল। নদীতে জোয়ার আসিল। স্টিমার ছাড়িল।' তার কথায় বলি-- 'এক অর্বাচীন তরুণ ঢাকা শহর ঠিকমতো চেনে না। সে বিস্মিত হয়েছিল, এই শহরে কোথাও কোনো ধানক্ষেত নেই, বহতা নদী নেই, জারুল তমাল আর শিরীষের বন নেই। সে ডবলডেকার বাসে করে মিরপুর থেকে প্রতিদিন কলেজ করত। আর বিকাল বেলা মিরপুরের নির্জন বধ্য এলাকাগুলোতে একাকী ঘুরে বেড়াত।' এই তরুণই রাত জেগে কবিতা লিখত। গল্প লিখত। তার কুসুমপুরের কথা লিখত। সে কেবল লিখেই রাখত। ছাপাতো না কোথাও। আবার সেইসব সে হারিয়েও ফেলেছিল। সে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই সে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তার কর্মজীবন। তার কথায় বলি---' কী কারণে জীবনের তেত্রিশ বছর লিখলাম না। তা আমি বলতে পারব না।' সে ছিল নাকি তার লেখালেখির গ্রহণকাল। ছাত্র অবস্থায় তিনি লেখালিখি করতেন এবং সুনামও কুড়িয়েছিলেন। হঠাৎ করে তাকে এ ভূবনে আর বিচরণ করতে দেখা যায় নাই। কেন যে নিজেকে এ ভূবন থেকে অন্য ভূবনে সরিয়ে নিয়েছিলেন তার উত্তর সময়ই হয়তো তার কাছে থেকে পাওয়া যাবে। সে একজন অস্থির চিত্তের মানুষ। কোনো কর্মেই তিনি স্থির নয়। যাযাবরীয় জীবন পছন্দ হলেও বেঁধেছিলেন তিনি মায়াবী সংসারের বেড়াজালে। তারপরেও সে ঘুরেছে বাংলাদেশের পথে পথে। কখনো চন্দ্রনাথের পাহাড়ে উঠে মন্দির দেখেছেন, কখনো দেখেছেন আদিনাথের পাহাড় থেকে সাগরের জলরাশি। সন্ধ্যা নদীতে সন্ধ্যাবেলায় নৌকা নিয়ে ঘুরেছেন। আবার খানজাহান আলী র মাঝারে বসে প্রার্থনায় রত হয়েছেন। জীবনকে দেখেছেন তিনি মানুষের কাছে যেয়ে। কখনো সে আরব ভূমির মরুবালুতে রেখেছে চোখ।আবার নেপালের ধূলিখেলের ধূলিও লাগিয়েছে চোখে। দার্জিলিংয়ের সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে দেখেছে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা। আবার ব্যাংককের পাতাইয়া বালুকাবেলায় হেঁটেছে হিপ্পিদের মতো চোখ মেলে সাগর পানে। সে উড়ে চলে গিয়েছিল হলিউডেও। সেখানে বিখ্যাত সব স্টুডিও গুলোতেও সে ঘুরেছে। জীবনকে তিনি উপভোগ করেছেন নানা বৈচিত্র্যে। তাইতো তিনি নিজের জীবনকে হারিয়ে ফেলেননি। তার লেখাতেই সন্ধান পাওয়া যায় একজন মায়াবতীর কথা। ব্যাক্তি জীবনে তিনি একজনের স্বামী ও তিন সন্তানের পিতা। তার কথায়, তার সহপাঠী বন্ধু আফজালুল বাসারের প্রেরণা ও গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়ার কারণে সে আবার লেখালেখি জগতে ফিরে এসেছে। তার চারটে গল্পের বই এখন প্রকাশিত-- 'পূর্ণিমানিশীথিনী-সম', 'মহুয়া বনে' 'দেবযানী ' ও রোল নং ১৭ দোলা মিত্র। তার প্রথম উপন্যাস 'অপ্রাপণীয়া'। যে উপন্যাস বিপুল পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে।