সে এক সময় এসেছিল এই দেশে, এই ঢাকায়, ষাটের দশক, আয়ুব খানের সামরিক শাসনের কাঁটাতারে বিদ্ধ, কবিতার তথা সাহিত্যের কামড়ে অস্থির যুবাদের পদভারে কম্পিত, বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধ-ভেঙে-ফেলা প্রতিবাদী তারুণ্যের আন্দোলনের ধাক্কায় টলটলায়মান, সামাজিক-অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের আঘাতে জর্জরিত। নতুন সময়ের নতুন ভাষাকে প্রকাশ করবার তীব্র বাসনায় একত্রিত হয়েছিল কয়েকজন অতিতরুণ, বের করেছিল সাহিত্যপত্র কন্ঠস্বর (যার লেখকেরা পরবর্তীকালে বিখ্যাত হবেন ষাটের দশকের কবি-লেখক বলে, আবদুল মান্নান সৈয়দ কিংবা রফিক আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো কেউ-কেউ দশকের গণ্ডি পেরিয়ে মহাকালের গায়ে খোদিত করবেন নিজের নাম, পরে এসে যোগ দেবেন নির্মলেন্দু গুণ বা আবুল হাসান)। সেই কণ্ঠস্বর সম্পাদনা করা, প্রকাশ করা, তার জন্য অর্থসংগ্রহ করতে গিয়ে জিভ-বের-হয়ে-আসা গ্লানিকর কষ্টকর অধ্যবসায় চালিয়ে যাওয়া আর লেখক-সাহিত্যিকদের বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার কেন্দ্রীয় ভূমিকাটি পালন করেছিলের কিছুটা অগ্রজ, সৃজনশীল সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ভালোবাসার সাম্পান সেই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রে সৃজনশীলতার নৌকা বয়ে নিয়ে যাওয়া নাবিকের স্মৃতিচারণার গল্প। এ গ্রন্থের কুশীলব হলেন সেদিনের তরুণ কবি-লেখকেরা, আজকের তরুণদের কাছে যাঁরা নায়কের আসনে অধিষ্ঠিত, যাঁদের প্রত্যেকের গল্প হতে পারে আলাদা আলাদা উপন্যাস। আর গ্রন্থের নায়ক হলো স্বরাট সার্বভৌম সময়-মধ্যষাট থেকে মধ্যসত্তর-এমন সময়কাল একটা জাতির জীবনে আসে কদাচিৎই। এই বইয়ের প্রাণটুকু হলো ভালোবাসা, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো বিশালহৃদয় মানুষের প্রতিটা সৃজনশীল সাহিত্যিকের জন্য নিখাদ নিঃশেষ স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা এবং একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও স্বদেশের জন্য একদল ভবিষ্যৎভাবনাবিহীন শৃঙ্খলমুক্ত তারুণ্যের অস্তিত্ব-কাঁপানো ভালোবাসা। ভালোবাসার সাম্পান একই সঙ্গে ইতিহাস ও কিংবদন্তি, উপন্যাস ও স্মৃতিকথা; অনবদ্য আবেগদীপ্ত ও বুদ্ধি-ঝলকিত ভাষাশৈলীতে গাঁথা এ হলো আমাদের জাতির এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, একটা সাহিত্যিক সম্প্রদায় বা একদল সাহিত্যিকের বেড়ে ওঠার হাহাকারের সঙ্গে যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে একটা জাতির জন্ম-চিৎকার। এ গ্রন্থ আরম্ভ করলে শেষ না করে বন্ধ করা মুশকিল এবং এ গ্রন্থ হাতে পেলে সংগ্রহ-ছাড়া করা অসম্ভব।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।