রবিজীবনীর অষ্টম খণ্ড প্রকাশিত হল। এই খণ্ডের পরিধি ১৩২৭-২৯ বঙ্গাব্দ [1920-23]। এর কিছু আগেই পঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে শাসক ইংরেজের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেও গান্ধীজি-সহ সমস্ত ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা শাস্তির ভয়ে নির্বীর্যতার প্রতীক হয়ে নির্বাক ছিলেন, তখন একজন কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ড ঘৃণায় ইংল্যান্ডের তথা ভারতের সম্রাট পঞ্চম জর্জের দেওয়া ‘স্যার’ উপাধি পরিত্যাগ করে ভাইসরয় চেম্স্ফোর্ডের কাছে একটি অগ্নিগর্ভ পত্র প্রেরণ করেন। ইংরেজ তার সাম্রাজ্যবাদী ঔদ্ধত্যে সেই চিঠিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবজ্ঞা করে—সরকারিভাবে রবীন্দ্রনাথ আজীবন ‘স্যার’ই থেকে যান—কিন্তু সমগ্র বিশ্বে এই পত্র মানবিকতার দলিল হয়ে ইংরেজের সভ্যতাগর্বকে ধিক্কার দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে সকল জাতি ও সংস্কৃতিকে মিলনবন্ধনে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে 23 Dec 1918 তারিখে রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর আদর্শ প্রচারকল্পে তিনি ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। এই আদর্শ বিদেশেও প্রচার করার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তাই গান্ধীজির আমন্ত্রণে 1920-র প্রথমে তিনি যখন আমেদাবাদ ও বোম্বাই ভ্রমণ করছিলেন, তখন পার্শি বণিক বোমানজির নির্বন্ধাতিশয্যে তিনি ইংল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার তদন্তের ফলাফল হান্টার কমিশন রিপোর্টের আকারে পার্লামেন্টের বিবেচ্য ছিল। বোমানজির উদ্দেশ্য ছিল, এই সময়ে ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের বিবেকী উপস্থিতি সম্ভবত পার্লামেন্টের আলোচনাকে প্রভাবিত করবে। তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি, ইংরেজ নীতিনির্ধারকেরা অপরাধীদের গুরুপাপে লঘুদণ্ড বিধান করে। রবীন্দ্রনাথ ধিক্কারে ইংল্যান্ড ছেড়ে মহাদেশীয় য়ুরোপে চলে যান। রবীন্দ্রনাথের মিলনবাণী তাঁরাই সাদরে গ্রহণ করলেন। এই সমাদর প্রত্যক্ষ করে রবীন্দ্রনাথের যে পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ ছিল ‘A Centre of Indian Culture’ গড়ে তোলাতে, তা-ই পরিবর্ধিত হল ‘An Appeal for an International University’-তে, তিনি চাইলেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যার আদর্শ হবে ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্’। এর বিপুল ভার নিজের ক্ষমতায় বহন করা কঠিন জেনে তিনি পরিষদ-সভা প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বভারতীকে তুলে দিলেন সাধারণের হাতে। প্রধানত এই প্রয়াসের প্রাথমিক ইতিহাসটি বর্তমান খণ্ডের তিনটি অধ্যায়ে যথাসাধ্য বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
Proshantokumar Paul-এর জন্ম ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫ (১৮ মে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। কলকাতায়। শৈশব কেটেছিল কৃষ্ণনগরে, প্রাথমিক পড়াশোনা এ. ভি. স্কুলে। কৈশোর ও যৌবন কলকাতারই স্কুলে-কলেজে। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে বাংলায় অনার্স নিয়ে বি-এ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এম-এ পাশ করেছেন ১৯৬০ সালে। ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা শুরু করেন কলকাতার আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা করতে করতেই রবীন্দ্রজীবনের বিবর্তনের সঙ্গে মিলিয়ে ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্ররচনা পড়তে গিয়ে অনুভব করেন যে, রবীন্দ্রজীবনীর এক বিশাল অংশ তমসাবৃত অবস্থায় রয়েছে। উৎসাহী হয়ে শুরু করেন। গবেষণা, অবশ্য ডিগ্রি-প্রত্যাশার বাইরে দাঁড়িয়ে। ১৯৭২ থেকে সেই নবতর গবেষণার সূচনা। ১৯৮২-তে ‘রবিজীবনী’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রকাশমাত্রই এ-গ্রন্থ সর্বস্তরে তোলে আলোড়ন। ১৯৮৪-তে বেরোয় দ্বিতীয় খণ্ড। একইভাবে সমাদৃত হয় এই নতুন খণ্ডও। ১৯৮৫ সালে ‘রবিজীবনী’র জন্য দুটি বিশিষ্ট পুরস্কার পান। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাস পুরস্কার ও সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার। বিশ্বভারতীতে আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থা প্রবর্তিত অশোককুমার সরকার স্মৃতিবৃত্তির প্রথম প্রাপকরূপে ১৯৮৫ সাল থেকে তিন বৎসর শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে গবেষণা করে প্রশান্তকুমার ১৯৯৩-এর। শেষ থেকে সেখানকার অধ্যাপক পদে কাজ করেছেন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটুট তাঁকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে সম্মানিত করেছেন। ২০০১-এ পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার রবিজীবনী সপ্তম খণ্ডের জন্য।