বাঙালী পাঠকের কাছে শ্রীযুক্ত সজনীকান্তের নূতন করিয়া পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক। কিন্তু যাঁহার স্বতঃসিদ্ধ পরিচয় সাহিত্যিক হিসাবে, বর্তমান গ্রন্থে তাহার পুরাতাত্তিক-রূপে। আবির্ভাব হয়ত অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর। কাব্য ও কৌতুক, বাস্তব ও ব্যঙ্গ, মধু ও হুল লইয়া যাঁহার কারবার, তিনিই আবার বিগত কালের দুষ্প্রাপ্য কীটদষ্ট দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটিয়া, ঐতিহাসিক সাধনার কঠিন পথে, রসিকের ধর্মের সহিত পণ্ডিতের কর্মের মণিকাঞ্চন সংযােগ ঘটাইয়াছেন। ইহা সম্ভব হইয়াছে, কারণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি সজনীকান্তের শ্রদ্ধা ও অনুরাগ অপরিসীম। ঐতিহাসিক তথ্যান্বেষণের ইহাই তাহার আন্তরিক প্রেরণা, যাহা আজ বহুরূপী বিদূষককে বহুসন্ধানী গবেষকে পরিণত করিয়াছে। এই পরিণতি যে নিষ্ফল হয় নাই, তাহার নিদর্শন বর্তমান গ্রন্থেই পাওয়া যাইবে; কিন্তু গ্রন্থের পিছনে গ্রন্থকারের যে নিবিষ্টতা ও নিষ্ঠা রহিয়াছে, তাহাই ইহার সত্যকার পরিচয় বহন করিতেছে। অতি-আধুনিক লেখকের মত আগামী কালের স্পর্ধায় স্ফীত না হইয়া, সুস্থিতবুদ্ধি সজনীকান্ত গত যুগের গৌরবে শ্রদ্ধাশীল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নূতন শিক্ষা ও আদর্শের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে যে দেশব্যাপী জাগরণের সূত্রপাত হইয়াছিল, তাহাই বাংলা গদ্যের প্রথম যুগের সূত্রপাত করিয়াছিল। কিন্তু বেশীদিনের কথা না হইলেও এই সদ্যোবিগত শতাব্দীর ইতিবৃত্ত আমরা প্রায় ভুলিতে বসিয়াছি। প্রাচীনতর যুগ সম্বন্ধে আমরা অনেক সংবাদ রাখি, কিন্তু যে-যুগ আমাদের এত নিকটবর্তী এবং আমরা এখনও যে-যুগের ভাব বিপ্লবের ফলভাগী, তাহার সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান যে খুব বেশি তাহা বলা যায় না। যাহা সুদূর তাহার সম্বন্ধে মােহ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু যাহা সমীপবর্তী এবং যাহা আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূত্রে আবদ্ধ, তাহার বিচিত্র কাহিনীও কম চিত্তাকর্ষক হইবার কথা নয়। হয়ত আমরা পুরাবৃত্তের অধিকতর পক্ষপাতী,কিন্তু যাহা আমাদের ঘরের কথা, আমাদের পিতামহদের বিস্মৃত বৃত্তান্ত, তাহাও শুনিতে কৌতূহলের অভাব থাকিতে পারে না। গত শতাব্দী সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতার কারণ উদাসীনতা নয়; স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যাহা লেখা থাকে তাহাই আমরা শিখি; তাহাতে পুরাকালের কথাই বেশি পাইয়া থাকি, গতযুগের বাংলাদেশের কথা এত সহজলভ্য নয়।