লেখক হিসেবে মার্জিযা লিপি মোটেই আমার পরিচিতি ছিলেন না। তাঁর ’আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন’ নামে বইটির নামও ছিলো অজানা। কোনো বিশেষ সূত্রে বইটি হাতে পেয়ে শুধু শিরোনামের কারণেই পড়তে অঅগ্রহী হয়ে দেখি মার্জিয়া লিপি জীবনের এমন একটি পর্বের আবরণ বা উপলব্ধি একের পর এক উন্মোচন করছেন যা আমাদেও মত পূরুষদের কাছে নতুন কথার মত শোনায়। উপলব্ধিতে এই বোধটিই কাজ করেঃ এমন করে কোন মা তার আসন্ন প্রথম সন্তানের জন্ম সম্পর্কিত উপলব্ধি প্রকাশ করেনি। লক্ষ করেছি এই প্রকাশের মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নেই, অনুভব ও উপলব্ধি, আকাঙ্খা ও ইচ্ছার মিশেলে জন্ম নেবার আগেই একটি শিশু যেন পরিণত বয়স প্রাপ্ত হয়ে মার সঙ্গে আলাপচারিতায় একাকার হয়ে যায়, বরং বলা যায়-মা ও শিশু এবং শিশু ও মা একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। বইটির মূলে প্রবেশ করার পূর্বে আমি রবীন্দ্রনাথের ’শিশু’ কাব্যগ্রন্থের জন্মকথা’ কবিতাটির শরণ নিতে চাই। কবির খোকা মার কাছে জানতে চায়: ’খোকা মাকে শুধায় ডেকে- ’এলেম আমি কোথা থেকে, কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।’ মা শুনে কয় হেঁসে কেঁদে খোকারে তার বুকে বেঁধে- ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’ খুবই সাধারণ প্রশ্ন- বধু কখন মা হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। জবাবটাও সাদামাটা- নিজেকে পরিপূর্ণ করে খুঁজে অর্থবিত্ত-অলঙ্কার-দালানকোঠার চাইতে সন্তানের ইচ্ছা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন তার সকল কিছু একটা বিন্দুতে এসে মেশে, কবি মা হয়েই বলেন: আমার চিরকালের আশায় আমার সকল ভালবাসায়—- মা সন্তানকে সাজিয়ে তুলতে গিয়ে নিজের মধ্যে আরেকটি ভূবন সৃষ্টি করে, সেই ভুবনের অদৃশ্য বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে তাকে পরিণত করে তেলেন, তার অনুভূতিই ভিন্ন , স্বাদ সম্পুর্ন পৃথক। মার্জিয়া লিপির আমার মেয়ে : আত্মজার সাথে কথোপকথন পড়তে গেলে মনে হবেই-যেন-মাতা-কন্যার সংলাপ। দুটি মাত্র চরিত্র, একজন দৃশ্যমান, আরেকজন ক্রমশ: বেড়ে ওঠা অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা, যাকে বহিরঙ্গে স্পর্শ করা যায়, অন্তরঙ্গে মেতে ওঠা যায় না। কিন্তু এখানেই মার্জিয়া লিপির কৃতিত্ব-তিনি অদৃশ্য অথচ অনাগত শিশুর সঙ্গে কথা বলে বলে পাঠককে জানিয়ে দেন, সন্তানসম্ভবা মা মূলত দুজনেরই প্রতিনিধি। যেহেতু দুজন, সেজন্যে একে অপরকে সনাক্ত করার জন্যে কথার মালা বুনে বুনে এমন একটা জগৎ সৃষ্টি করে, যে জগতে অতীত থাকে, বর্তমান রয়ে যায়, ভবিষ্যৎ মূর্ত হয়ে ওঠে। এবং তিনটি কালের মধ্যে আমাদের এই ভবিষ্যৎ-মা শুধু মাতৃত্ব ও সন্তানবাৎসল্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দেন চেনা সীমানা থেকে সীমানার বাইরে। কি নেই সেই সীমানার ভেতরে ও বাইরে? প্রথমেই বলি দেশের কথা। এই দেশের জন্ম ইতিহাস, বাংলার ইতিকাহিনী, মার্চ, আমার বাংলাদেশের পতাকা, বাঙালির প্রিয় উৎসব পহেলা বৈশাখ, পাখি, প্রকৃতি, সমাজের নানা কথা, ইরাক যুদ্ধ ও বাদ যায় না, কাহলিল জিবরানের জীবন দর্শন, জাহানারা ইমামের অমর সৃষ্টি’একাত্তরের দিনগুলি’-এককথায় মার্জিয়া লিপির অনাগত শিশুর সঙ্গে কথা যেন নিঃশেষিত হবার নয়। আমি বলবো, মার্জিয়া লিপি কথাচ্ছলে, একটি শিশুর ভ্রুনবস্থা থেকে শুরু করে জন্ম নেবার সময় পর্যন্ত যে পরস্পর বিচ্ছিন্ন বা পারস্পর্যপূর্ন কথামালা গেঁথে যান, তা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার কাছে ইতিহাসের শৈপ্লিক বিবরণ বলে মনে হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন আসে- আমাদের মায়েরা তাদের শিশুকে ইতিহাস সচেতন করে গড়ে তুলতে কতটা সচেতন। সাধারণ একজন পাঠক পাঠেই চমকে উঠবেন- মা যে শিশুর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলছেনতা কি ওই নিদিষ্ট শিশুর জন্যই প্রযোজ্য? প্রকৃতপক্ষে তা নয়। এখানেই আমাদেও ইতিহাস পাঠ বা জানার গুরুত্বটা বৃদ্ধি পায়। আমাদের মায়েরা কতটা ইতিহাস সচেতন তা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ; সাথে এই প্রশ্নটিও অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, জন্মদাতা পিতা অনাগত শিশুর ভবিষ্যত নিয়ে কতটা ভাবিত? ইতিহাস বিস্মৃতি আমাদেও একধরনের বিলাসিতা, মায়েদেও জন্য জরুরী বিষয় হলেও বাংলাদেশের শতকরা কতজন মা দেশ-মানুষ-ইতিহাস –প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন? মার্জিয়া লিপির এই দৃষ্টিভঙ্গিই আমাকে আশান্বিত করে- একজন তরুণী মা যখন সামগ্রিকভাবে বিষয়টি ভাবতে শুরু করেছেন, পাঠকদের উপহার দিচ্ছেন, তখন এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে আরেক তরুণী মা তার সন্তানকে শুধু স্কুলের পাঠ্য বইয়ে শিক্ষিত করে তুলবেন না; দেশ-বিদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-মানুষ-মানবসভ্যতা-বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়েও পূর্ন কাে তুলতে চাইবেন। অনাগত শিশুর সঙ্গে কথা বলা প্রসঙ্গেই আমার ইটালিয়ান বিখ্যাত সাংবাদিক আরিয়ানা ফালাচির ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ বইটির কথা মনে এলো। এখানেও অনাগত শিমুর সঙ্গে কথোপকথন। তবে মার্জিয়া লিপির ’আত্মজার সাথে কথোপকথন’ গটে বাস্তব শিশুর সঙ্গেই, যে শিশু জন্মই নেয়নি তেমন কল্পিত শিশুর সঙ্গে নয়।আমি এই বাস্তব শিশুটিকে বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র হিসেবে দেখতে চাইছি। মার্জিয়ার গর্ভে ভ্রুনটি আসার পর থেকে তিনি কথা এঁকেছেন, ছবি লিখেছেন। অশ্রুত বিষয়কে শ্রাব্য করে পাঠককে উপহার দেবার জন্যে আমি তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই-গর্ভধারন তথা সন্তান জন্মদানের মত গভীর আনন্দবেদনাময় বিষয় পূরুষের অভিজ্ঞাতার সম্পুর্ন বাইরে হলেও মানবজন্মের চিরন্তন সত্যের সঙ্গে একীভূত হয়ে এ বই সবশ্রেনীর পাঠকের জন্যে এক অনিবার্য পাঠ্যবিষয় হয়ে ওঠে। মার্জিয়া লিপি, আপনার বইটি আমি গভীর মনোযোগে পড়তে বাধ্য হয়েছি।
মার্জিয়া লিপির জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৫ অক্টোবরে কিশােরগঞ্জ জেলায়। মা : ফিরােজা আক্তার বাবা : মাে: মােয়াজ্জেম হােসেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুগােল ও পরিবেশে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালের দৈনিক ইত্তেফাক’ এ পরিবেশ বিষয়ক তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। পরিবেশবিদ মার্জিয়া লিপি বাংলাদেশ বনবিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বেপজায় ছিলেন; বর্তমানে ইউএসএইড-এর প্রকল্পে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরামর্শক পদে কর্মরত। লেখকের উপকূলে বিশেষত পৃথিবীর সর্ববৃহত্তম একক ম্যানগ্রোভ বন-সুন্দরবনে কাজ করার অভিজ্ঞতায় লেখা-প্রকাশনা- বাংলাদেশের উপকূল : পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। প্রকাশিত গ্রন্থ : আমার মেয়ে : আত্মজার সাথে। কথােপকথন, জীবনীগ্রন্থ সরদার ফজলুল করিম।। সম্পাদিত প্রকাশনা- সরদার ফজলুল করিম : দিনলিপি, মা-দুই বাংলার সাহিত্য সংকলন। শিশু-কিশাের সংকলন- চিরদিন তােমার আকাশ, চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, আমরা সবাই রাজা, পাখি সব করে রব।