“মাক্সিম” এর কিছু কথা: এই আশ্চর্য বইটি (১৬৬৫) পড়ন্তে পড়তে একুশ শতকের মানুষকে যা স্তম্ভিত করে দেয় তা এর অমোঘ আধুনিকতা। সময়ের ঢেউকে অতিক্ৰম করে আবহমান মানুষের প্রকৃতি নির্ধারণের জন্য এ এক যন্ত্রণাক্ত, নির্জন তপশ্চর্য, সাড়ে তিনশ বছর পরেও যার মূল্য এতটুকু কমেনি। ভলতের এই বইয়ের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন সেই শিল্পগুণ যা ফ্রান্সের রুচি তৈরিতে সাহায্য করেছে, ফরাসি মনকে শিখিয়েছে পরিমিতি। শুধু লা। শোপেনহাওয়ার, নীৎসে বা আঁদ্রে জিদ নয়, এই অন্তদৃষ্টিময় সজীব ও সুষম বাক্যগুলি যুগে যুগে সাধারণ মানুষকেও আলোকিত করেছে। অনেকের মতে, এটি চিন্ময় গুহ-র শ্রেষ্ঠ অনুবাদ কর্ম। “মাক্সিম” প্রথম সংস্করণের ভূমিকা: ফরাসিতে লা রোশফুকের ‘নির্দয়’ (টি. এস. এলিয়টের ভাষায়) মাক্সিমগুলি পড়ে মনে হয়েছিল এগুলি বাংলায় অনুদিত হওয়া উচিত। প্রধানত উন্নাসিক পণ্ডিতদের কাছে পরিচিত হলেও এই উক্তিগুলি তো সর্বসাধারণের জন্য। মাক্সিম(Maximes)গ্রন্থটি (পুরো নাম Refiexions On Sentence et Maximes morales)প্রকাশিত হওয়ার ৩২৫ বছর পরে বর্তমান অনুবাদ-সংকলনটি প্রস্তুত করার সময় কিছুটা চয়ন আমাদের করতেই হয়েছে, যাতে শ্রেষ্ঠ ও যুগোন্তীর্ণ উক্তিগুলি হারিয়ে না যায়।‘বর্জিত মাক্সিম’-গুলিও (Maximes Supprimées)। এখানে অনুপস্থিত, কারণ লা রোশফুকো নিজেই সেগুলির সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তবে তীর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত মাক্সিমগুলি (যা Maximes Posthumes বা “মরণোত্তর মাক্সিম’ নামে খ্যাত) থেকে কিছু নির্বাচিত উক্তি এখানে সন্নিবিষ্ট করা হল। কখনো কখনো কয়েকটি ফরাসি শব্দের তাৎপর্য বাংলায় ফুটিয়ে তোলা দুরূহ মনে হয়েছে। যেমন ‘Vertu’ বলতে সব সময় ‘পুণ্য” বোঝানো হয়নি, কাজেই অন্য শব্দ (গুণ বা সদগুণ) ব্যবহার করতে হয়েছে। সূচক প্রবন্ধটি লেখার ব্যাপারে আমাকে নানা ফরাসি ভাষ্যকার ও সমালোচকের মতামতের সাহায্য নিতে হয়েছে; এদের মধ্যে জাক ক্র্যাশে, পিয়ের ক্লারাক, জাক ব্রস ও ওদেৎ দ্য মুরুগের নাম উল্লেখযোগ্য। পাসকালের একটি উদ্ধৃতিতে (পৃ-১৭) আমি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বাংলা ভাষান্তর ব্যবহার করেছি। অনুবাদের সময় নানা সমস্যা নিয়ে বারবার ছুটতে হয়েছে কবি অরুণ মিত্রের কাছে। বেশ কয়েকটি মাক্সিমের অনুবাদে তীর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বইপত্র দিয়ে উপকার করেছেন আমার অন্যতম পদক্ষেপে সাহায্য করেছেন শ্ৰীমতী অনসূয়া গুহ, সহ-অনুবাদক হিসেবে তার নাম ছাপা হলেও বলার কিছু থাকত না। “মাক্সিম” এর শেষের কিছু কথা: লা রোশফুকো (১৬১৩-১৬৮০)-র খ্যাতি পাশ্চাত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মরালিস্ট হিসেবে। এই জীবনদ্রষ্টাকে অনেকে ইউরোপের ‘প্রথম ক্লাসিক মনতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করেছেন।ব্যক্তিগত জীবনে রাজপুরুষ ও সেনাপতি। অনুবাদক চিন্ময় গুহ (জ. ১৯৫৮) পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েক বছর হল “দেশ’ পত্রিকার একটি বিভাগের সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরাসিবিদ হিসেবে সমধিক পরিচিত। দিল্লির ভাষার অধ্যাপনা করেছেন এক দশকের বেশি। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বারো। টি এস এলিয়ট সম্পর্কিত গ্রন্থটি সারা বিশ্বে সমাদৃত। একই সঙ্গে ইংরেজি, বাংলা ও ফরাসিতে লিখে থাকেন ।
চিন্ময় গুহ-র জন্ম ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কলকাতায়। প্রাবন্ধিক, ফরাসিবিদ ও অনুবাদক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। ফরাসি শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রক তাঁকে আলাদাভাবে দু’বার ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন ২০১০ এবং ২০১৩ সালে। শিক্ষা জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচ ডি। দিল্লির ফরাসি দূতাবাসের প্রাক্তন প্রকাশনা-উপদেষ্টা। ‘দেশ” পত্রিকার গ্রন্থ-সমালোচনা বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন এক দশক। গবেষণা করেছেন প্যারিস, অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজে। বক্তৃতা ও সভাপতিত্বের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন সরবন, অক্সফোর্ড, এডিনবরা সহ নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ফরাসির ভক্ত স্বয়ং দেরিদা। চারটি ভাষায় কুড়িটির বেশি বই। শখ: ফরাসি অভিধান পড়া, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো।