"আওয়ামী লীগ বিরোধী নই তবুও সমালোচনা করি" বইটির ভূমিকা বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন নিবন্ধ পাঠ করে অনেকেই আমার ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন- গাছের ডালে বসে গাছ কাটার মতো আমার নিবন্ধগুলাে ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহত্যারই নামান্তর হয়েছে । আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যারা চেনেন সেই যৌবনের ছাত্রলীগ, পরবর্তীকালের রাজনৈতিক পথ পরিক্রমণের বিভিন্ন বিপত্তির স্থানে আমার নিবন্ধগুলাে পত্রিকায় পাঠ করে আমার ফেসবুকে নানা ধরণের মন্তব্য পাঠকরা করেছেন। এরমধ্যে কঠোর সমালােচনা ছিল না তা নয়, তবুও আমার সৌভাগ্য এবং আমার এটাই পাওনা যে আমাকে আওয়ামী লীগের বাইরে ভাবেননি। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল করেন তার প্রতিবাদ করে সংসদ থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে মৌলিক অধিকারের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের যেকোন পদক্ষেপের আমি সাধ্যমত প্রতিবাদ করেছি। কারণ, গণতন্ত্র আমার কাছে নিছক একটি শব্দ নয়, বরং জ্বলন্ত আদর্শ । গণতন্ত্রের ব্যত্যয় দেখলে নিশ্ৰুপ থাকা আমি পাপ মনে করি । তাই, জীবনে যখন যে অবস্থায় থেকেছি গণতন্ত্রের স্বপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে কুণ্ঠিতবােধ করেনি; ভয় পাইনি। কোন রুদ্ররােশের আশঙ্কায় নিজেকে বিরত রাখিনি। তার আমলিন ছাপ এই গ্রন্থটির পাতায় পাতায় ছত্রে ছত্রে রয়েছে। আনুষঙ্গিকতা ও প্রাসঙ্গিকতার পরিমাপের ভার পাঠকের। পাঠকের প্রতি আমার আশ্বাস, আমার এই প্রতিবাদী প্রচেষ্টা কখনােই থমকে যাবে না। জীবন থমকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। প্রসঙ্গতঃ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে অকৃতিম কৃতজ্ঞতা জানানাে আমার কর্তব্য, মানবজমিন ও ধন্যবাদ প্রাপ্য। বাংলার প্রান্তিক জনতা এ লেখনী থেকে যদি একটুও উজ্জীবিত, উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত হয় তবেই স্বার্থকতা খুঁজে পাব নইলে দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে তিলে তিলে দ্বগ্ধীভূত হতে থাকল।
তিনি বিগত শতাব্দীর ষাট দশকের এক অনবদ্য সংগ্রামী পুরুষ। ঐ দশকের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী তুর্কি তাজির মতো ক্ষুরের দাপটে মেদিনী কাঁপিয়েছেন। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের কালজয়ী সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্নেহাস্পর্শে গণতন্ত্র, অসম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক চেতনায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মনু মিয়ার রক্তাক্ত জামা নিয়ে ’৬৬-এর ৭ জুন ঢাকায় আইউববিরোধী মিছিলের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে একজন বলিষ্ঠ ও সুযোগ্য ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭০-এর নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি হিসেবে তিনি যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা এদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১-এর ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সব সভায় সভাপতিত্ব করার একক গৌরব তাঁর। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃ চতুষ্টয় আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করার পর সেই পতাকাটি তিনি সগৌরবে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। তিনি আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে আজও তিনি বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ-ত্যাগ এবং নেতৃত্বের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে নিজেকে অবিচল অবস্থানে ধরে রেখেছেন। দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যে কক্ষচ্যুতি, পথভ্রষ্টতা, স্বার্থমগ্নতা এবং নিজ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, নূরে আলম সিদ্দিকী তাতে বিচলিতবোধ করেন। বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহে ১৯৪৪-এর ২৬ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নূরনবী সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়ার ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৬-এর জুনে ছয় দফার পক্ষে আয়োজিত হরতালে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। অতঃপর ১৭ মাস কারান্তরালে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং ঐ বন্দিদশায়ই তিনি স্নেহময়ী জননী নূরুন নাহার সিদ্দিকীকে হারান। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রে ট্রিপল এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালে আইনশাস্ত্রেও উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও শত অপমানে জর্জরিত হয়েছেন; প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছে তাঁকে। বর্তমানে তিনি ডরিন গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি সাবেক সাংসদ এবং প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়কও। প্রকাশিত গ্রন্থ ৫টি : ‘একাত্তরের অজানা কাহিনী: এক খলিফার বয়ান’, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী নই, তবুও সমালোচনা করি’, ‘কালের কলধ্বনি’, ‘সংঘাত সংশয় সাফল্য’ ও ‘ইতিহাস একদিন কথা বলবেই’।