শতাব্দীর চুম্বন-সাঈদা আজিজ চেীধুরী কবিতার সংজ্ঞা কি, কবিতা কার প্রতিনিধি, কবিতা দিয়ে কি হয়, এতো সমস্ত জেনে বুঝে কেউ কবিতা লিখতে শুরু করে না। বরং অনুভূতি প্রবণ, জীবনের প্রতি গভীর অনুরাগ, সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ ও অসত্য অসুন্দরকে ঘৃণা করার চেতনা যার মধ্যে আছে, তিনি কবিতা লেখার প্রয়াসী হন। কবির প্রাপ্তি অর্থাৎ আর্থিক প্রাপ্তি কম। তবে ভালোবাসা ও সম্মান ক্রমাগত প্রসার লাভ করে এমনকি কবির মৃত্যুর পরও পাঠক শুভানুধ্যায়ীগণ কবির জন্য রচনা করেন স্মৃতিস্তম্ভ। তবে যে প্রকৃত কবি সে প্রাপ্তির আশা করে না। বরং জীবনব্যাপী কবিতা চর্চার একটা দাগ রেখে যায় সময়ের স্রোতে। যদি জিজ্ঞেস করা হয়- কতলোক কবিতা লেখে? চিন্তনহীন স্বতস্ফূর্তার বাইরে গিয়ে কবিতায় যারা আবেগ ও যুক্তির সংশ্লেষ তৈরী করে তারা সংখ্যায় কম। এ রকম কবির সংখ্যা ১০ জনের বেশি নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেনÑ ব্যর্থ কবি ও ব্যর্থ প্রেমিকের সংখ্যায় সমান। প্রেমে ব্যর্থ হবে জেনেও যারা প্রেম করে তারাই প্রকৃত প্রেমিক। কবিতা লিখে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থাকলেও যারা আজীবন কবিতা চর্চা করে তারাই কবি। তবে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেগে থাকলে কাব্যদেবী বিমুখ করবে না। আর বৈচিত্রময় বাংলা কাব্যদেবী কোনো শ্রমশীল কবিকে বিমুখ করেননি। এমনকি কায়কোবাদ, বন্দে আলী মিয়া, গোলাম মোস্তফা, গোবিন্দ চন্দ্র দাস, বেনজীর আহমদ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মাঈনুদ্দীন-এর মতো কবিরাও পাঠ্যপুস্তকে স্থান করে নিয়েছেন। সুতরাং চর্যাপদের কাল থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক কবিতার ইতিহাসে গেলে কবিরাও পাঠ্যপুস্তকে স্থান করে নিয়েছেন। সুতরাং চর্যাপদ চর্চার কাল থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক কবিতার ইতিহাসে গৌণ কবিরাও উচ্চারিত হন ঐতিহাসিক কারণে। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম এখন অনবরত উচ্চারিত কেননা তিনি স্বজাতির প্রতি মাতৃভাষায় দায়বদ্ধ থেকেছেন। বলেছেন অতি ক্ষোভ ও আক্ষেপের সাথে “যে জন বঙ্গেতে জন্মে/হিংসে বঙ্গ বাণী/সেসব কাহার জন্ম/নির্ণয় না জানি। এটি ভাষা আন্দোলনের এক অমেয় বাণীগাথা। সৈয়দ আলী আহসান একজন প্রসিদ্ধ কবি ও প্রাবন্ধিক। তিনি যখন বলেন- “আমার পূর্ববাঙলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তসলি”। তখন তিনি দেশপ্রেমের আন্তরিকতায় উচ্চারিত হন। মাইকেল মধুসূদন থেকে রবীন্দ্র নাথ, নজরুল থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্য। ফররুখ আহমদ থেকে আহসান হাবীব। শামসুর রাহমান থেকে আল মাহমুদ। শহীদ কাদরী থেকে রফিক আজাদ। নির্মলেন্দুগুণ থেকে আবুল হাসান। আবিদ আজাদ থেকে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এভাবে আমরা যদি বিবেচনা করি, দেখব বাংলা কাব্য সাহিত্যের পরম্পরা খুবই সুশৃঙ্খল। পরবর্তী আশির দশক থেকে দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত উত্তরাধুনিকতার ঝুলি নিয়ে ঘুরলেও তারা আধুনিক কবিতার পথিকৃত জীবনানন্দ দাশকে অস্বীকার করতে পারে না। তার উত্তরসূরী বিনয় মজুমদার ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিতে হয় সঙ্গে। আমরা তরুণ ও নবীন কবিদের পাঠ না করেই তাড়িয়ে দিতে উদ্যত। কিন্তু তারণ্যের শক্তিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে নতুন কবিদের পাঠ করি, তাদের তরতাজা অনুভবকে আনন্দের সাথে যুক্ত করি। আমি যখন তরুণ কিংবা কারো বইয়ের ভূমিকাদি লিখি তখন তার শক্তিকে আবিষ্কার করতে তৎপর হই। হাতে এলো এক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। লিখতে হবে ভূমিকা। কবি সাঈদা আজিজ চেীধুরীর “শতাব্দীর চুম্বন”। এই কবির একটি কবিতার কয়েকটি চয়ন তুলে দিচ্ছি “পৃথিবীর অন্দরে নীলিমার বন্দরে কী বিস্ময়করভাবে বেঁচে আছি! শতাব্দীর সিঁড়িপথে কার্নিশে পদযুগল, ধাপগুলো ধীরলয়ে হেঁটে চলেছি উদয়াস্তের কালান্তরে শিশিরের ঝরে পড়া, সোনালি সূর্য ঋতুর পাখিদের আসা-যাওয়ার পথে পথে পাহাড়ের বুকে নিরোদপুঞ্জ বেঁচে আছি রক্তজবার দোল খাওয়া পুষ্প রেণুকুঞ্জ”। প্রকৃত প্রস্তাবে বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম তার আদল রক্তজবার মতো রক্তিম সংগ্রামময়। যতই পুষ্পরেণু কুঞ্জ দৃশ্যমান হোক ভেতরে আছে ক্ষরণ আর যন্ত্রণার ভয়াবহতা। জীবন যেন একগুচ্ছ রক্তজবা। সাঈদা আজিজ চৌধুরী জীবন ও জগতকে ছুঁয়ে দেখতে চান। গাঁ, গঞ্জ, নগর ও বন্দর, লোকজীবন ও শহুরে যাপন এমনকি বর্হিবিশ্বের জীবন ধারার একটা কোলাজ অনুষঙ্গ তার কাব্যভাবনাকে তাড়িত করে। তিনি বৈচিত্রময় কাব্য আঙ্গিকের ভেতর দিয়ে রক্তজবার জারন তৈরী করেন। বাংলা কবিতার বৈচিত্র কম। কিন্তু এক্ষেত্রে ইউরোপীয় কবিতা অগ্রণী। হোমার থেকে হিসেনেথ, সাফো থেকে শেক্সপিয়র। র্যাবো থেকে বিলকে, নেরুদা থেকে নাজিম হিকমত, নেপোলিনিয়র থেকে এলিয়ট, বোর্হেস থেকে ব্রদমিক ইরেটস থেকে আখমাতোভা, মিল্টন থেকে মায়াকোস্টিট, গ্যাটে থেকে সুইজ স্মার্ক পর্যন্ত বিশ্ব কবিতার বৈচিত্র অকল্পনীয়। আমরা বাংলা ভাষার কবিরা ক্রমাগত বিশ্বায়ণের দিকে যাচ্ছি। ত্রিশের দশক থেকে এই যাত্রা অব্যাহত আছে। কিন্তু নিজস্বতাকে বিসর্জন দিয়ে নয় বরং নিজের পটভুমিকে নতুন সৌন্দর্যবোধে উন্নীত করার প্রয়াস থাকা উচিত আমাদের কবিদের। আমাদের প্রতিটি অক্ষরে ২১ শের শহীদের রক্ত লেপে আছে। আছে স্বাধীকার ওঙ্কার। কবি সাঈদা আজিজ চৌধুরী সমাজ সচেতন গভীরতাগামী এবং সামাজিক দায়বোধ সম্পন্ন কবি। তার শব্দগুলো শিল্পের জাদুতে নতুন অর্থ উত্থাপন করে। “অনন্ত কোলাজ“কবিতার লাইনগুলো উদ্ধৃত করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। “কৃত্তিকা স্বাক্ষরিত আকাশ পাবলোর কোলাজ পাহাড়ের বুক জমাট মেঘের দস্তানা জলজ তন্তুজ মেঘাত্মার ওপার পালক খসে পড়া বালিহাঁস অভ্রের নীলে অভিমান ঝরা অতলান্ত পারদ” এই কবিতাটিও সম্প্রসারিত বাস্তবতায় সমর্পিত। সাঈদা আজিজের বড় গুণ হলো চিত্রকল্পময়তা। তিনি অক্ষরবৃত্তে বেশ স্বচ্ছন্দ। জীবন ও জাতিকে দেখার যে শক্তি তার আছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের প্রাণিত করে। তার “শতাব্দীর চুম্বন”কবিতার বইটি পাঠক প্রিয় হোক প্রত্যাশা করি।